এস. এম তৌফিক।।
মাছিম্যান বইটি সায়েন্স ফিকশন গল্প সংকলন বা গল্পগ্রন্থ। বইটিতে জায়গা পেয়েছে লেখকের ১৪ টি ভিন্ন ভিন্ন ফিকশন গল্প। জায়গা পেয়েছে এলিয়েন, প্যারালাল ইউনিভার্স, টাইম ট্রাভেল, ব্রেইন অ্যানালাইসিস, অদ্ভুত প্রিন্টার, মানুষ-রোবট-এলিয়েন এর ত্রিমাত্রিক প্রেম, দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান আলোর খেলার সাথে নলেজ ট্রান্সফার, টেলিপ্যাথি এর মত নানান বিচিত্র বিষয়াদি।
প্রচ্ছদকারী বইটির নাম ও ধরণের সাথে মিল রেখে বইয়ের প্রচ্ছদটিকে খুব দারুণভাবে রূপদান করেছেন। এককথায় একটি সায়েন্স ফিকশন বইয়ের জন্য ঠিক যেমন প্রচ্ছদ মানানসই এবং যা খুব সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো।
লেখক পরিচিতি
সাহিত্যের প্রতি আসিফ মেহ্দীর ঝোঁক ছাত্রজীবন থেকেই। দেশসেরা দুই ফান ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’ ও ‘রস+আলো’তে লেখার সুবাদে রম্যলেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন আগেই। সেই সূত্রে প্রথম বইটাও রম্যগল্পের। ‘বেতাল রম্য’ নামের সেই বইয়েই আসিফ মেহ্দী লাভ করেন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। এরপর একে একে প্রকাশিত তাঁর প্রতিটি বই শুধু পাঠকপ্রিয়তাই লাভ করেনি, উঠে এসেছে বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায়। সাম্প্রতিক সময়ে লিখছেন দেশসেরা কিশোর ম্যাগাজিন ‘কিশোর আলো’তে।
কাহিনী সংক্ষেপ
লেখক যেহেতু ১৪ টি গল্পকে তার এই বইটিতে জায়গা দিয়েছেন, তাই আমি গল্পগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে তুলে ধরব;
পোড়ো কারখানা
এই গল্পটি মূলত আগুনে পুড়ে যাওয়া একটি কারখানাকে ঘিরে। যে গল্পে ‘হাতির মত মাথা, ক্যাংগারুর মত নিচের অংশ’ এরুপ এক ধরণের বিশেষ প্রাণীর কথাও ফুটে উঠেছে।
ফিরে এসো মানুষ
এ গল্পে এমন এক পরিস্থিতির বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে সারা পৃথিবীতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইন্টারনেট অকেজো হয়ে যায় এবং বিভিন্ন ডাটা হারিয়ে যেতে থাকে। যন্ত্র পাগল মানব সমাজের মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এ কাজটি করেন পৃথিবীর বড় বড় ৭ জন বিজ্ঞানী।
ইলেকট্রনিক বার্তা
এখানে একজন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির প্রোগ্রামার এর কাছে একদিন একটি ই-মেইল আসে। ই-মেইলটি মূলত পৃথিবীর মানুষটিকে প্লুটো গ্রহে যাওয়ার আমন্ত্রণপত্র; প্রেরক ছিলেন প্লুটো গ্রহের এক এলয়েনের যিনি পেশায় একজন শিক্ষক।
অপারেশন গামা
গল্পটিতে মানুষকে আক্রমণের জন্য মানবকে নিয়ে এলিয়েনদের বিভিন্ন ভাবনার পাশাপাশি হাস্যরসের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। তবে প্রশ্নফাঁস যে মানবজাতির জন্য কতটা ক্ষতিকর, তা এ গল্পে দারুণভাবে ফুটে উঠেছে।
ধন্যবাদ
টাইম ট্রাভেল সম্পর্কিত গল্পটি বাবা-ছেলের ভালবাসায় পরিপূর্ণতা লাভ করে। যে গল্পে কিশোর বয়সে বাবা হারানো সন্তান পরবর্তীতে নিজের আবিষ্কার ‘সময় পরিভ্রমণের উপায়’ এর মাধ্যমে অতীতে এসে তার বাবাকে ‘ধন্যবাদ’ জানাতে আসে।
ভুলোমনা বিজ্ঞানী
এই গল্পে একজন বিজ্ঞানীর ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বা অভ্যাসের বিষয় নিয়ে কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। গল্পটিতে দেখা যায়, বিজ্ঞানী একইসাথে সময় এবং স্থানের পরিভ্রমণের জন্য বিশেষ ধরণের টাইম ওয়াচ আবিস্কার করেন। একসময় তার স্ত্রী তার কৈশোরকালে টাইম ট্রাভেল করার আগ্রহ জানালে তিনি তার স্ত্রীকে ১৫ বছর অতীতে পাঠিয়ে দেন কিন্তু তার স্ত্রীর ভুলে আরো অতীতে চলে যাওয়া এবং বিজ্ঞানী তার টাইমওয়াচটিকে চার্জ দেয়ার কথা ভুলে যাওয়ার ফলে তার স্ত্রীর আর বর্তমানে ফিরে আসা হয় না।
টপ সিক্রেট
এ গল্পে এলিয়েনদের অস্তিত্ব নিয়ে মানুষের গবেষণার দিকটি তুলে ধরার পাশাপাশি এলিয়েনরাও যে সংকটে পড়ে পৃথিবীতে মানুষের রূপধারণ করে এখানে এসে থাকতে পারে সেরকম একটি ব্যাপারটিকেই তুলে ধরা হয়েছে।
প্যারাডক্স
স্বামী-স্ত্রীর সাংসারিক ঝামেলার এক পর্যায়ে স্ত্রীর জেদের কারণে স্বামীর ব্রেন এনালাইসিস করার জন্য ‘ ব্রেন অ্যানালাইজার সেন্টারে’ নিয়ে যাওয়া হয় এবং ভিডিও ক্যাসেটের মত একটি মাল্টিমিডিয়া প্লেয়ারের মাধ্যমে একইসাথে মানুষের অতীত এবং তখন তার মাথায় চলতে থাকা ভাবনার উভয়ই দৃশ্যায়ন হয়।
নববর্ষ
এ গল্পে যেনো একজন কবির বাস্তবিক জীবনের করুণ অবস্থা চিত্রায়িত হয়েছে, যে গল্পের শেষে এক বিশেষ ধরণের প্রিন্টারের জানান দেওয়া হয়েছে; যার কাজ মূলত ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো’ এর মতোই বলা চলে।
এলিয়েন কোটা
গল্পটি খুবই মজার যেখানে মানুষে-রোবটে-এলিয়েনে এক ত্রিমাত্রিক প্রেমের কাহিনী ফুটে উঠেছে। যে গল্পে ‘কোটা’ তে একজন মানুষ হেরে যায় এলিয়েনের কাছে।
অন্য আলোয়
এটি মূলত ‘আলোর ভিন্ন ভিন্ন ব্যান্ড বা দৃশ্যমান, অদৃশ্যমান আলোর ভাবনা’ এর পাশাপাশি ‘প্যারালাল ইউনিভার্স’ এবং প্যারালাল ইউনিভার্সের কারো কাছ থেকে ‘নলেজ ট্রান্সফার’ বিষয়ক চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।
লেটুস মামার নতুন মিশন
এ এক ভবিষ্যতের গল্প। যেসময় মানুষ বিদেশ যাওয়ার মতো করে সহজেই চলে যাবে অন্য গ্রহে। এককথায় তাকে ‘ইউনিভার্সালাইজেশন।’ তবে গল্পে মানুষের বিলুপ্তির দিকেও একটি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
কিঞ্চিৎ মিথ্যা
এই গল্পে একজন বিজ্ঞানীর জীবনসঙ্গী হিসেবে কোনো নারী এলিয়েনকে বিয়ে করার আকাঙ্ক্ষার চিত্র ফুটে উঠেছে। একসময় বিজ্ঞানী ‘মিথ্যা নির্ণায়ক যন্ত্র’ আবিস্কার করেন এবং সে সম্পর্কে জানতে হঠাৎ একদিন এক এলিয়েন নারী বিজ্ঞানীর কাছে আসেন এবং যথারীতি বিজ্ঞানীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে অবাক করে দেয়।
মাছিম্যান
এই গল্পে ভিনগ্রহের এক বিশেষ প্রাণী ‘মাছিম্যান’ এর পরিচয় পাওয়া যায়। যে কিনা দেখতে মাছির মতো কিন্তু মুখখানা মানুষের মতোই। সে তার নিজ গ্রহ থেকে পৃথিবীতে এসেছে মাছিদের নিয়ে গবেষণা করতে। এই প্রাণীটির আবার টেলিপ্যাথিকভাবে অন্যের ব্রেনের চিন্তা-ভাবনা জানতে পারা এবং ব্রেনে বিভিন্ন কমান্ডও পাঠানোর অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে এভাবেই সাজানো হয়েছে গল্পটি।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
বইটা পড়ার শুরু থেকে শেষ অবধি দারুণ এক ভাললাগার অনুভূতি কাজ করেছে আমার মনে। যেনো হাস্যরস আর সাই-ফাই একত্রে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে একেকটি গল্পে। ফিকশন প্রেমীদের কাছে মনের খোরাক হিসেবে এ বইটি হতে পারে এক দারুণ প্যাকেজের মতো। আসিফ মেহদী’র এমন লেখনীতে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া ছাড়া পাঠকদের উপায় নেই বললেই চলে। আর তার শব্দ বুননকৌশল এ বইটির ক্ষেত্রেও বরাবরের মতোই সুন্দর। বইটির প্রতিটি গল্প ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা-ভাবনায় বইটির পাঠকদেরকেও সাই-ফাই জগতের ভিন্ন ভিন্ন ধারণার দুয়ারে ঠেলে দিবে বলে আমি মনে করি।
প্রিয় লাইন
- মুঠোফোন আধুনিক মানুষদের এতটাই মুঠোবন্দী করে ফেলেছে যে এখন টেলিভিশনের অনুষ্ঠানও মানুষ দেখে মুঠোফোনে। (গল্প: ফিরে এসো মানুষ)
- কারণ যা-ই হোক, মহাবিশ্বের ইতিহাসের প্রথম মানুষ-এলিয়েনের সাক্ষাৎকার পর্বটি হয়তো পিছিয়ে গেল হাজার বছরের জন্য। (গল্প: ইলেকট্রনিক মেইল)
- এবার হায়দার রেহানার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নারী রহস্যময়ী, এটা একটা ভুল কনসেপ্ট। প্রকৃতিতে রহস্যময়ী হলো সময়।’ (গল্প: ভুলোমনা বিজ্ঞানী)
- মজিদের মতে,বিশ্বকাপের ‘থিম সং’ -এর মতো প্রত্যেক মানুষের একটা করে ‘থিম সং’ থাকা উচিত। (গল্প: প্যারাডক্স)
- মজিদের মনে হলো, ভালোবাসার মত প্যারাডক্স নাই-যন্ত্রণা বাড়ায়; আবার যন্ত্রণা কমায়! (গল্প: প্যারাডক্স)
- আসলে সময় তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না; আবৃত্তি করে মানুষকে কবিতা শোনাতে পারছেন, এটিই তার ভালো লাগা তৈরি করে। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন না হলে টাকা তিনি নিতেন না। (গল্প: নববর্ষ)
- “প্রবল ভালোবাসাকে অ্যাভোগেড্রো সংখ্যা দিয়ে গুণ দিলে যতটুকু হবে, আমি তোমাকে ততটুকু ভালোবাসি।” (গল্প: এলিয়েন কোটা)
- আজ থেকে শুরু হবে আমাদের নতুন মিশন; মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের জাগরণ।’ (গল্প: লেটুস মামার নতুন মিশন)
বিশেষ দিক
এ বইটির সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে, বইটিতে লেখক রম্য বা হাস্যরসের পাশাপাশি সাই-ফাই জগতের নানাদিক যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন তার পাশাপাশি তিনি সমাজের নানা সমস্যাকে যেমন- প্রশ্নফাস, মনুষ্যত্ব, অতিমাত্রায় যন্ত্রনির্ভরতার মত বিষয়াদিকে ভিন্ন আঙ্গিকে পাঠকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং এক্ষেত্রে তাকে শতভাগ সফলই বলা চলে।
সমালোচনা
এত সুন্দর একটি বইয়ের একমাত্র সমালোচনার দিকটি হচ্ছে এর মুদ্রিত মূল্য। বইটির মুদ্রিত মূল্য নিয়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্টদের আরেকটু ভাবা উচিত ছিল এবং বইটির মুদ্রিত মূল্য আমার নিকট একটু বেশিই মনে হয়েছে।
উপসংহার
এদেশের ফিকশন প্রেমীদের কাছে ‘মাছিম্যান’ বইটি জায়গা করে নিবে অন্যতম উচ্চতায়, ফিকশন প্রেমীদের ভাবনাকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলবে বলে মনে করি। বইটি পড়ার পর লেখকের অন্যান্য বইগুলোও পড়ার জন্য মনে আগ্রহ জাগবে, উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে পরবর্তী বইয়ের অপেক্ষায় এমনটাই আশা করা যায়।
এক নজরে বই;
বই: মাছিম্যান
লেখক: আসিফ মেহদী
প্রচ্ছদ: মাহবুব রহমান
ধরণ: সায়েন্স ফিকশন
প্রকাশনী: প্রথমা প্রকাশন
মুদ্রিত মূল্য: ১৮০/-

জন্ম কুমিল্লায়। নিউজ পোর্টাল আওয়ার ইসলামে সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করেছি পাঁচ বছর। চলমান সময়ে নতুন কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত সময় পার হচ্ছে।