দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মো. সাহাবুদ্দিন। এর আগে ২১ মেয়াদে মোট ১৭জন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই হিসাবে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে সোমবার শপথ নেওয়া মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন এই পদে অষ্টদশ ব্যক্তি৷
চলুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বাংলাদেশে এ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা রাষ্ট্রপতিদের তালিকা-
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেরশ প্রত্যাবর্তনের পর ১২ জানুয়ারি সেই পদ পরিত্যাগ করেন। প্রথম মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন মোট ২৭০ দিন। এ সময় তাঁর রাজনৈতিক দল ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। একই বছরের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে একদল বিপথগামী সেনা। এই মেয়াদে তাঁর রাজনৈতিক দল ছিল বাকশাল।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম
সৈয়দ নজরুল ইসলাম একজন রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর ১৯৭২ সালে ১২ জানুয়ারি দায়িত্ব থেকে অবসর নেন। তাঁর রাজনৈতিক দল ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
আবু সাঈদ চৌধুরী
নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরী দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৭২ সালে ১২ জানুয়ারি। আর ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সর্বমোট ১ বছর ৩৪৬ দিন দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর দলের নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ
১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ। তিনি ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একাধারে আইনজীবী ও রাজনীতিক ছিলেন। পরে তিনি সংসদ সদস্য, ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকারও নির্বাচিত হন। তিনিও ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের।
খন্দকার মোশতাক আহমেদ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় বিপথগামী সেনাসদস্য। তখন অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। একই বছরের ৬ নভেম্বর তাঁকে পদচ্যুত করা হয়। মাত্র ৮৩ দিন ক্ষমতায় থাকা খন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক দল ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম
বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত আইনবিদ এবং প্রথম প্রধান বিচারপতি। খন্দকার মোশতাককে সরিয়ে ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে থাকা সেনাসদস্যেরা। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
জিয়াউর রহমান
জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রাক্তন সেনাপ্রধান এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সরিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। চার বছর বাংলাদেশ শাসন করার পর ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নিহত হন তিনি।
আব্দুস সাত্তার
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আব্দুস সাত্তার প্রথমে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের সময় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এ বিচারপতির বয়স ছিল ৭৬ বছর। পরে তিনি ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক আইন জারির মাধ্যমে প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাতে চলে যায়।
আ ফ ম আহসানউদ্দীন চৌধুরী
আ ফ ম আহসানউদ্দীন চৌধুরীর প্রকৃত নাম আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসানউদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশের হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি এবং ১৯৭৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণার পর ২৭ মার্চ আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত করেন। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর এরশাদের চাপেই তিনি আবার পদত্যাগ করেন।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর দেশ পরিচালনাকে অনেকেই সামরিক একনায়কতন্ত্রের সাথে তুলনা করেন। তিনি জাতীয় পার্টি নামক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে বেশ কিছু উপদলে বিভক্ত হয়। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৩ আসন হতে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালে ক্ষমতা দখলের পর দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের কথা বলে তিনি ১৯৮৬ সালে সংসদীয় সাধারণ নির্বাচন দেন। এ নির্বাচনে তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন এবং পরে পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে গণবিক্ষোভের চাপে এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনের অভাবে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত আইনবিদ ও ষষ্ঠ প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ দুবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথমে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং পরে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় থাকাকালীন ১৯৯৬ সালের ২৩ জুলাই থেকে ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আবদুর রহমান বিশ্বাস
বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালুর পর বিএনপি প্রথম শাসনামলে ১৯৯১ সালের ৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আবদুর রহমান বিশ্বাস। ১৯৯৬ সালের ৮ অক্টোবর তাঁর মেয়াদ শেষ হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি তাঁর আনুগত্য ছিল পাকিস্তান সরকারের প্রতি।
অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী
অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী একজন বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিনি উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। কিছুদিন পর ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিএনপির এ নেতা। ২০০২ সালে এক বিতর্কিত ঘটনার জেরে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন ও পরবর্তীকালে আরেকটি রাজনৈতিক দল বিকল্প ধারা বাংলাদেশ গঠন করেন।
জমির উদ্দিন সরকার
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে দুই দফা দায়িত্ব পালন করা জমির উদ্দিন সরকার দুই মেয়াদে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। পেশায় আইনজীবী এই রাজনীতিক আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। ১৯৭৫ পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারার প্রবর্তন করেন।
অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ
২০০১ সালে সরকার গঠন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। ২০০২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ জোট সরকারের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জিল্লুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিলে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের কার্যকাল সমাপ্ত হয়। এর মধ্যে তিনি তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবেও বাড়তি দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত হন। পরে জরুরি আইন জারি করে ২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি এ পদ ছেড়ে দেন। এ পদে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন বিশ্বব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ।
জিল্লুর রহমান
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমান ১৯তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন। ২০১৩ সালের ২০ মার্চ পদে থাকাকালেই তিনি মারা যান। সে সময় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার মো. আবদুল হামিদ।
মো. আবদুল হামিদ
জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর মো. আবদুল হামিদ প্রথমে ভারপ্রাপ্ত পরে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ নিজের দ্বিতীয় মেয়াদে এবং দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সপ্তম জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকার এবং নবম জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে তিনি এবার বিদায় নিচ্ছেন।
মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন
আজ সোমবার বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিলেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। এখন পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করা অষ্টাদশ ব্যক্তি তিনি। এর আগে তিনি সাবেক জেলা ও দায়রা জজের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত এই ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও মূল দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধেও সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন তিনি।
