আব্দুল্লাহ আফফান।।
কিংবদন্তি অমর শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তিনি একজন বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি বাবা আলাউদ্দিন খান নামেও পরিচিত। সেতার ও সানাই এবং রাগ সঙ্গীতে বিখ্যাত ঘরানার গুরু হিসাবে সারা বিশ্বে তিনি প্রখ্যাত। তিনি প্রথম বাঙালী যিনি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যে এই উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে পরিচিত ও প্রচার করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে বিখ্যাত এক সঙ্গীতশিল্পী পরিবারে ১৮৬২ সালের এপ্রিল মাসে তার জন্ম। তার পিতা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁ ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতঙ্গ। আলাউদ্দিনের ডাকনাম ছিল আলম।
বাল্যকালে অগ্রজ ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর নিকট সঙ্গীতে তার হাতেখড়ি হয়। সুরের সন্ধানে তিনি দশ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এক যাত্রাদলের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। ওই সময় তিনি জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, পাঁচালি প্রভৃতি গানের সঙ্গে পরিচিত হন। অতঃপর কলকাতা গিয়ে তিনি প্রখ্যাত সঙ্গীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নুলো গোপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শিষ্যত্ব গ্রহণের সময় গোপাল কৃষ্ণ শর্তারোপ করলেন, কমপক্ষে ১২ বছর একনাগাড়ে সঙ্গীত সাধনা করতে হবে সেখানে থেকে।
আলাউদ্দিন খাঁ রাজি শর্তে হয়ে গেলেন। শর্তের সাত বছরের শেষ দিকে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন সঙ্গীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ। পিতৃহীনের মতো দুঃখ-শোকে কিছুদিন পাথর হয়ে রইলেন আলাউদ্দিন খাঁ। ক্রমে ক্রমে শোকের ভার কমলে অকস্মাৎ কণ্ঠসঙ্গীত সাধনা ছেড়ে দিয়ে তিনি যন্ত্রসঙ্গীত সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন করলেন। স্টার থিয়েটারের সঙ্গীত পরিচালক অমৃত লাল দত্ত ওরফে হাবু দত্তের নিকট তিনি বাঁশি, পিকলু, সেতার, ম্যাডোলিন, ব্যাঞ্জু ইত্যাদি দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন। সেই সঙ্গে তিনি লবো সাহেব নামে এক গোয়ানিজ ব্যান্ড মাস্টারের নিকট পাশ্চাত্য রীতিতে এবং বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ অমর দাসের নিকট দেশীয় পদ্ধতিতে বেহালা শেখেন। এছাড়া হাজারী ওস্তাদের নিটক মৃদঙ্গ ও তবলা শেখেন। এভাবে তিনি সর্ববাদ্য বিশারদ হয়ে ওঠেন।
আলাউদ্দিন খাঁ কিছুদিন ছদ্মনামে মিনার্ভা থিয়েটারে তবলা বাদকের চাকরি করেন। অতঃপর আলাউদ্দিন খাঁ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার জগৎকিশোর আচার্য চৌধুরীর সংগীত সভায় যন্ত্র বাদনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে জগৎকিশোর সানন্দে তার ব্যবস্থা করে দেন। জানা যায়, আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতে পারদর্শীতা দেখাবেন এমন অভিলাষ নিয়েই সকাল বেলায় সভায় আসন গ্রহণ করেন। সেখানে ভারতের বিখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ আহমেদ আলী খাঁর সরোদ বাদন শুনে তিনি সরোদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁর নিকট পাঁচ বছর সরোদে তালিম নেন। এরপর ভারতখ্যাত তানসেন বংশীয় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর নিকট সরোদ শেখার জন্য তিনি রামপুর যান। ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ রামপুরের নবাব হামেদ আলী খাঁর সঙ্গীত গুরু ও দরবার সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। আলাউদ্দিন খাঁ তাঁর নিকট দীর্ঘ ত্রিশ বছর সেনী ঘরানায় সঙ্গীতের অত্যন্ত দুরূহ ও সূক্ষ্ম কলাকৌশল আয়ত্ত করেন।
মাইহারের রাজা ব্রিজনাথ আলাউদ্দিন খাঁকে নিজের সঙ্গীত গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত করলে তিনি মাইহারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বেরিলির পীরের প্রভাবে তিনি যোগ, প্রাণোয়াম ও ধ্যান শেখেন। এভাবে জীবনের একটা বড় অংশ আলাউদ্দিন শিক্ষার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন।
অতঃপর শুরু হয় তার কৃতিত্ব অর্জনের পালা। ১৯৩৫ সালে তিনি নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকার প্রতিটি দেশে তিনি শ্রোতাদের বিমোহিত করে তোলেন। এ সময় তিনি ইংল্যান্ডের রানী কর্তৃক সুরসম্রাট খেতাবপ্রাপ্ত হন। ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব পদ্মভূষণ ছাড়াও পদ্মবিভূষণ, বিশ্ব ভারতীয় দেশীকোত্তমসহ দিল্লি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি।
তিনিই ভারতীয় উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের নিকট পরিচিত করান। তিনি উদয় শঙ্কর পরিচালিত নৃত্যভিত্তিক কল্পনা শীর্ষক একটি ক্ল্যাসিকধর্মী ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন। আলাউদ্দিন খাঁ সরোদে বিশেষত্ব অর্জন করেন। সহজাত প্রতিভাগুণে তিনি সরোদ বাদনে ‘দিরি দিরি’ সুরক্ষেপণের পরিবর্তে ‘দারা দারা’ সুরক্ষেপণ পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। সেতারে সরোদের বাদন প্রণালী প্রয়োগ করে সেতার বাদনেও তিনি আমূল পরিবর্তন আনেন। এভাবে তিনি সঙ্গীত জগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন, ‘যা আলাউদ্দিন ঘরানা’, ‘মাইহার ঘরানা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
আলাউদ্দিনের পরামর্শ ও নির্দেশে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবিত হয়। সেগুলোর মধ্যে ‘চন্দ্র সারং’ ও ‘সুর শৃঙ্গার’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি অনেক রাগ-রাগিনীও সৃষ্টি করেন। যেমন— হেমন্ত, দুর্গেশ্বরী, মেঘবাহার, প্রভাতকেলী, মেহবেহাগ, মদন মঞ্জুরি, মোহাম্মদ (আরাধনা), মানঝ খাম্বাজ, ধবল শ্রী, সরস্বতী, ধনকোশ, শোভাবতী, রাজেশ্রী, চন্ডিকা, দীপিকা, মলয়া, কেদার, ভুবনেশ্বরী ইত্যাদি।
মাইহার রাজ্যে তার বাসভবন ‘মদিনা ভবনে’ ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বলে গেছেন যে, তিনি কিছুই শিখতে পারেননি, শেখার আরও অনেক কিছু শেখা বাকি রয়ে গেলো। দৃঢ় সংকল্প, অধ্যবসায় ও ঐকান্তিকতা থাকলে মানুষ যে যেকোনো অসাধ্য সাধন করতে পারে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

জন্ম কুমিল্লায়। নিউজ পোর্টাল আওয়ার ইসলামে সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করেছি পাঁচ বছর। চলমান সময়ে নতুন কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত সময় পার হচ্ছে।