জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘হিমালয় পেরিয়ে’

এস, এম তৌফিক।।

বিহানের আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিলো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়া। সিএ পড়ার শুরুতেই খোঁজখবর নিতে গিয়ে শুনলো গরিবদের জন্য সিএ নয়। শুনে সংকল্প আরো দৃঢ় হলো রিহানের। ধনুকভাঙা পণ নিয়ে সে এগিয়ে গেলো তার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। স্বপ্ন পূরণের পথে এগোতে গিয়ে দেখলো দীর্ঘদিনের প্রেমিকা হয়ে গেলো অন্যের। আপনজন হয়ে যেতে লাগলো পর। নিকটজনদের অসহযোগিতা আর নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা হিমালয়সম বাধার দেয়াল হয়ে উঠলো তার সামনে। পিছনে তাকিয়ে দেখলো বিশ্ব চরাচরে কোথাও কেউ নেই। সময়ের ভারে বেড়ে যাচ্ছে বয়স। আর্থিক, শারীরিক, মানসিক প্রতিকূলতা ছাপিয়ে সে কি পেরোতে পেরেছিল বাধার হিমালয়? দুর্নিবার বাধা পেরিয়ে সে কি আনতে পেরেছিল নতুন দিনের উজ্জ্বল আলোয় ঝলমলে রৌদ্রশাত সোনালি ভোর? বইটিতে রয়েছে একজন সিএ ছাত্রের জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পেরোনোর গল্প।

নামকরণ ও প্রচ্ছদকথন: বইটির নাম ‘হিমালয় পেরিয়ে’ করার পেছনের মূল কারণ হচ্ছে উপন্যাসের মূখ্য চরিত্র রিহানের সিএ হওয়ার পথে হাজারো বাধার সম্মুখীন হয়েছে এ বাধাগুলোকে হিমালয়ের সাথে তুকনা করা হয়েছে। কারণ, সফলতার এসব বাধা মানুষের কাছে হিমালয়সম হয়ে দেখা দেয়। এসব বাধাকে জয় করে মানুষ যখন তার গন্ত্যব্যে এগিয়ে যেতে থাকে তা যেন হিমালয় জয়ের একেকটা বেস ক্যাম্প এবং সফলতার একেকটি ধাপ পার করা মানে হচ্ছে হিমালয় জয় করার পথে একধাপ করে এগিয়ে যাওয়া।

প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। তাকে নিয়ে বলার তেমন কিছুই নেই। এক্ষেত্রে তার নামই যেন ব্রান্ড এর মতন পাঠক সমাজ পরিচিত। তিনি বরাবরের মতোই এ বইটিতেও বইয়ের নামের সাথে মিলিয়ে দারুণ প্রচ্ছদ করেছেন যা পাঠকদের খুব সহজেই বইটির কাছে টেনে আনবে।

উৎসর্গনামা: একটি ১.৫ কি.মি রাস্তা। দক্ষিণ আটুলিয়া সংযোগ সড়ক । লেখকের জন্য যা সারা জীবনের দুঃখ। এই রাস্তার ধুলো, মাটি আর কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথ বেয়ে বেড়ে উঠেছে লেখকের শৈশব, কৈশোর থেকে শুরু করে জীবন যৌবনের বর্তমান পর্যন্ত। রাস্তাটি আজও পাকা না হওয়ার এই বইয়ের বিক্রয়লব্ধ সমস্ত অর্থ দিয়ে রাস্তাটি পাকা করার ব্যতিক্রমী এক স্বপ্ন বুনেছেন লেখক।

চরিত্রায়ন: রিহান, রিহানের মা-বাবা, রিপন, সুহা, বাবলু ভাই, আহনাফ, রিয়াজ, শায়ান, রিহানের ছাত্র আলিফ, জারা,শাহেদ,নিরিসহ আরো অনেকে।

কাহিনী সংক্ষেপ: উপন্যাসটি মূলত একজন সিএ রিহানের জীবন কাহিনী যেখানে রিহানের ছোটবেলা থেকেই দৃঢ় আগ্রহ ও স্বপ্ন থাকে সিএ হওয়ার৷ তার সাথে তার বন্ধু রিপন আগ্রহ দেখালেও পরবর্তীতে রিপন পিছু হটলেও রিহান একাই তার স্বপ্ন পূরণের পথে লড়াই চালিয়ে যায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের হওয়ায় তার মায়ের জমি বিক্রি করতে হয়। এদিকে আবার সুহার সাথে রিহানের দীর্ঘদিনের প্রেম এবং রিহানের ঢাকা চলে আসায় তাদের মধ্যে দূরত্ব, একে অন্যকে মিস করতে থাকার জন্য খারাপ লাগা বা আক্ষেপ দেখা যায়। পরবর্তীতে রিহানের ঢাকাতে ব্যাচেলর জীবনের সংগ্রাম, পাশাপাশি একদিকে ফাউন্ডেশন পরিক্ষা অন্যদিকে একইসময়ে খুলনায় মাস্টার্স পরীক্ষার পরিস্থিতি, আর্থিক সমস্যা, ফার্ম খুঁজে বের করা ইত্যাদি নিয়েই এগুতে থাকে গল্প৷ একটা পর্যায়ে ঘটনাক্রমে সুহার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়ার ফলে সুহাকে হারাতে হয় রিহানের। গল্পের ঘটনাক্রমে রিহানের একটা ভাল চাকরি হয় এবং রিহানের ছাত্র আলিফের বোন জারার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠলেও সুহাকে ভুলতে পারেনা রিহান। একটা সময় সুহার কথা কিছুটা ভুলতে পারকেও জারাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত ছিল না রিহান৷ সে সিএ পাস করার আগে বিয়ের কথা ভাবতেই পারেনা পরবর্তীতে জারারও বিয়ে হয়ে যায়। সময়ের পরিক্রমায় রিহানও সিএ পাশ করে এবং সবশেষে গ্রামের পাশেই নিরা নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করে।

পাঠ প্রতিক্রিয়া: এ গল্পটিতে একজন সিএ এর জীবনের নানা চড়াই-উতরাই, লড়াই, ধৈর্য, তার আর্থিক সমস্যা, হার না মানা লড়াই, বারংবার ব্যর্থ হয়েও হাল না ছাড়াসহ ইত্যাদি বিষয়াদি ফুটে উঠলেও এর পাশাপাশি লেখক রিহান চরিত্রটির জীবনে প্রেম,পারিবারিক বন্ধন, অডিটের সময়কার নানা স্থান ঘুরবার ভ্রমণকাহিনী, বন্ধুত্ব ইত্যাদি বিষয়াদিও দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন৷ যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এছাড়াও লেখকের শব্দ ভান্ডার, গল্পের প্লট, চরিত্রায়ন, গল্পের ধারা বিবরণী খুবই সুন্দর ও সাবলীল। যা গল্পটিকে পাঠকের কাছে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে বলেই আমি মনে করি৷ পাশাপাশি গল্পটি একইসাথে ক্যারিয়ার এবং রোমান্টিকতার মিশেলে উপস্থাপিত হওয়ায় গল্পটিকে গতানুগতিক ধারার উপন্যাসগুলো থেকে আলাদা মনে হয়েছে।

বিশেষ দিক: বইটির উৎসর্গনামা এবং লেখকের মহৎ উদ্দেশ্য বইটির সবচেয়ে সুন্দরতম দিক। এছাড়াও গল্পটি ক্যারিয়ার এবং রোমান্টিকতার মিশেল অন্যতম বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলে মনে করি; যা অন্যান্য গল্প থেকে এ বইটিকে পাঠকের মনে আলাদা করে রাখতে পারে বলে আমার মনে হয়।

ঘাটতি: হ্যাঁ খুব সুন্দর। (১৫ নং পৃষ্ঠায় এই লাইনটিতে হ্যাঁ এরপর কমা (,) দেয়া হয়নি৷) পরবর্তীতে ৮৪ নং পৃষ্ঠাতেও এমন ভুল লক্ষ্য করা গেছে।

এছাড়াও বইটিতে বিভিন্ন শব্দযুগলের মাঝে যতিচিহ্ন হাইফেন (-) এবং উর্ধ্বকমা ব্যবহারের দিকটি বিবেচনায় টাইপ করার কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিকে একটু অমনোযোগী মনে হয়েছে।

সেরা লাইন

  • ভয় তারাই পায় যাদের কোন স্বপ্ন নেই।
  • আমার সৌভাগ্য। এতদিন জানতাম ছেলেরা মেয়েদের ঘোরাঘুরি করে। আজ তুমি উল্টো বলছো। অন্য ছেলেরা শুনলে বর্তে যাবে। সারা জীবনের তরে গোলাম হয়ে যাবে।
  • পৃথিবীর মানুষগুলো বোধহয় এমনই। এমনি খুব হাসিখুশি, পরোপকারী ভাব দেখায়, আশ্বাসের কথাও বলে; কিন্তু সত্যিকারের প্রয়োজনের সময় খুব কম মানুষকে কাছে পাওয়া যায়।
  • পৃথিবীতে এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার আর কেইবা আছে, মা ছাড়া!
  • এক জীবনে হয়তো সব পাওয়া হয় না অথবা পেতে নেই৷
  • মানুষ জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে সেসব মানুষের সাথে, যাদের জন্য সে আবেগ পুষে রাখে না।

সমালোচনা: রিহানের আর্থিক অবস্থান থেকে সিএ পড়ার ক্ষেত্রে তার কাছে অর্থ একটি অন্যতম ফ্যাক্টর। সেক্ষেত্রে কলাবাগান থেকে ফার্মগেট রিকশায় ক্লাসে যাওয়ার ব্যাপারটি বড্ড বেমানান মনে হয়েছে।
আলিফের বাবা রিহানের পাওনা টাকা পরিশোধ করার জন্য বিকাশে টাকা পাঠানোর কথা বলে। এক্ষেত্রে সেসময়ে বিকাশ ছিল কিনা এ ব্যাপারে সংশয় রয়েছে।

পরিবেশনা: বইটির প্রচ্ছদ, মলাট, ব্যবহৃত কাগজ, কালি বাইন্ডিংসহ অন্যান্য সকল বিষয়াদির কাজ খুবই সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে টাইপিং এর ক্ষেত্রে অমনোযোগ এবং বইটির মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বর্তমান পাঠক চাহিদা বিবেচনায় বইয়ের মূল্য কিছুটা বেশিই বলে মনে হয়েছে৷ যে ক্ষেত্রে প্রকাশনী হয়তোবা বইটির মলাট মূল্য ২৮০-৩০০ টাকা নির্ধারণ করতে পারতো বলে মনে করি।

ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৭.২ /১০

শেষকথা, লেখক সিরাজুল ইসলামের এই বইটি পরে লেখক নিজ জীবনে অনুপ্রেরণা, সফলতা, ধৈর্য, দৃঢ় মনোবল, স্বপ্নপূরণ, দায়িত্ববোধসহ জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে সক্ষম হবে এবং লেখকের অন্যান্য বইগুলোর দিকেও কিছুটা টান অনুভব করবে। যা একজন লেখকের লেখক হিসেবে আরো আরো এক ধাপ এগিয়ে হিমালয়সম পাঠকপ্রিয়তার পথে আরো একটি বেস ক্যাম্প স্থাপন করবে বলে আশা রাখি৷

এক নজরে বই
বই: হিমালয় পেরিয়ে
লেখক: মোঃ সিরাজুল ইসলাম এফসিএ
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মুদ্রিত মূল্য: ৪০০/-
প্রকাশনী: অমর প্রকাশনী