এস. এম তৌফিক।।
বইটির প্রচ্ছদ আর নাম উভয়ই উপন্যাসটির মতোই কিছুটা রহস্যময়। বইটির নাম ‘শেষ’ তার সাথে এমন একখানা প্রচ্ছদ দেখলে যে কারোর মনেই বইটি নিয়ে কৌতুহলের সৃষ্টি হবে। এ কৌতুহল সৃষ্টির জন্য আরেক সৃষ্টি মানে প্রচ্ছদকারী সঞ্চিতা সৃষ্টির এমন প্রচ্ছদ বাহবা পাওয়ার মতোই ।
ফ্ল্যাপের লেখা
নেহাত কথার প্রসঙ্গ ধরে ব্যক্তিগত আলাপের যে গল্প, সেই গল্পের হাত ধরেই একদিন শিহাব সিদ্ধান্ত নেয়, হাসানকে সে আত্মহত্যা করতে বলবে। তারপর দিনের পর দিন হাসানের সাথে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা কম হয়নি। এমতাবস্থায় একদিন এক সমঝোতা হয় তাদের ভেতরে। হাসান সম্মতি জানিয়ে বলে, চলে যাবার আগে পৃথিবী বরাবর কিছু লিখে যেতে চায়। সেই চিঠি শেষ করে হাসান আত্মহত্যা করবার জন্য দড়ি কিনতে ঘর থেকে বের হয়। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যায় সে ফেরে একটা অ্যাকুরিয়াম নিয়ে। সে আত্মহত্যা করবে না।
লেখক সম্পর্কে
জুনায়েদ ইভান জুনায়েদ ইভান ১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন । তিনি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ‘অ্যাশেজ ‘ নামক একটা রক ব্যান্ডের ভোকালিস্ট হিসেবে জনপ্রিয় হলেও সমাজের বিভিন্ন মানবিক কাজের জন্যও তিনি প্রশংসনীয়। শেষ ” তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ।
চরিত্র
হাসান , শিহাব , নিতু , রুদ্র , রফিক সাহেব , আজগর হােসেন , আবিদা সুলতানা , আনিকা , তিশা , ইমতিয়াজ আংকেল , রুবা আন্টি এবং আরো অনেকে।
কাহিনী সংক্ষেপ
গল্পে হাসান ও শিহাব রুমমেট। শিহাব একজন লেখক আর হাসান চাকুরিজীবী। এক সময় শিহাব তার গল্প লেখা আর এগিয়ে নিতে পারে না আবার অন্যদিকে সে আস্তে আস্তে হাসানের জীবনের গল্প জানতে আগ্রহী হয়ে পড়ে এবং আস্তে আস্তে হাসান শিহাবের সাথে তার জীবনের গল্প এবং প্রয়োজনের তাগিদে তার জীবনের সাথে জড়িয়ে যাওয়া বিভিন্ন লোকজনের সম্পর্কেও বলতে থাকে। এভাবেই গল্পটি এগুতে থাকে। এক পর্যায়ে, শিহাব তার গল্পটি রেখে হাসানের গল্পকেই বই আকারে রূপ দেয়ার জন্য পান্ডুলিপি সাজাতে থাকে। শেষদিকে এসে তার মনে হয় যেহেতু এটি একটি সত্য ঘটনার উপর গল্প এক্ষেত্রে হাসানের আত্মহত্যাটা তার গল্পের জন্য জরুরী। আর এ ভুল ভাবনার উপর নির্ভর করেই সে হাসানকে বিভিন্নভাবে আত্মহত্যার জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা করতে থাকে।
পাঠ পার্যালোচনা
গল্পটি প্রথমে দু’জন রুমমেট থেকে শুরু হলেও হাসান চরিত্রের মাধ্যমে তার সাথে জড়িয়ে থাকা তার স্ত্রী নিতু, হাসানের মেজো মামা ও মামীসহ ঘটনাক্রমে নিতুর সাবেক স্বামী রুদ্র, নিতুর বাবা-মা, বোন তিশা, নিতুর বাবার সাবেক প্রেমিকা এবং নিতুর মায়ের বান্ধবী রুবা এবং রুবার মেয়ে আনিকা ( যার জন্মদাতা নিতুর বাবা) এমন বিভিন্ন লোকজনের সম্পর্কে বা বলা যায় তাদের জীবনের গল্পও কিছুটা তুলে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে।
এ উপন্যাসটিতে আমাদের সমাজের সামাজিক গুয়ের্তুমি, পরিবার এবং পারিবারিক সম্পর্ক, পরিস্থিতিভেদে মানুষের বিভিন্ন আচরণ এবং সিদ্ধান্ত এসব নিয়ে এক রহস্যময় গল্পের দারুণ চিত্রায়ণ করেছেন লেখক জুনায়েদ ইভান। বইটির প্রতিটি লাইনে যেনো লুকিয়ে আছে জীবনের রহস্য, জীবনকে উপলব্ধি করার শিক্ষা। বইটি পাঠ শেষেও রুদ্রের দেয়া চিঠি নিয়েও একটা রহস্য রয়ে যাবে। আবার অনেক পাঠকের মনে হয়তোবা মনে হবে ইশ! এ বইটি যদি আরো দু’য়েকশ পাতা বেশি হতো তাতে কি বা এমন ক্ষতি হতো! আসলে বইটি জুনায়েন ইভান ঠিক এভাবেই লিখেছেন যার প্রতিটি পাতায় জীবনের উপলব্ধি আর রহস্যময় লাইন দিয়ে পরিপূর্ণ।
স্টোরি টেলিং
লেখক তার বইটিতে খুব সুন্দরভাবে গল্পটিকে ধাপে ধাপে চরিত্র ধরে ধরে বর্ণনা করেছেন। কিছু জায়গায় আগের ধাপের গল্পের কিছু অংশ পুনরাবৃত্তি করেছেন। যাতে পাঠকেরা গল্পে চরিত্রগুলোর ভূমিকা ভুলে না যায় বা গল্পের মিল হারিয়ে না ফেলেন। পাঠকদের নিকট যা খুবই দারুণ লাগবে।
প্রিয় লাইন
মানুষ দুটো সময় চুপ করে থাকে যখন তার কথা বলার কিছু থাকে না এবং যখন অনেক কথা থাকে কিন্তু সে বলতে পারে না।
“মানুষ কি আসলেই হারাতে পারে? হারিয়ে সে যাবে কোথায়? সবচাইতে বড়ো কারাগার হলো আকাশ। এত বড়ো আকাশ যে পালানো যায় না। আর সব চাইতে ছোটো কারাগার মানুষের মন।এত ছোটো যে প্রবেশ করা যায় না।”
সবাইকে নিয়ে একা থাকাটা অনেক বেশি কষ্টের সবাইকে ছাড়া একা থাকার চাইতে।
” একা মানুষের কোন পিছুটান থাকে না, কথাটা আসলে ঠিক না। জীবনের প্রতি ভালোবাসা হলো সব চাইতে বড়ো পিছুটান। ”
একা থাকা আর একাকিত্ব, এক কথা না।
যার কেউ নেই সে একা না, যে কারো না সে একা।
বিশেষ দিক
বইটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , মানিক বন্দোপাধ্যায় , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী , শক্তি চট্টোপাধ্যায় , পৃথিবীর প্রথম কবি এনহেদুয়ান্না , সফোক্লিস, শেলী, জিবরান, কনফুসিয়াস , সক্রেটিস , মলিয়ের , লিওনার্দো কোহেনের কথা টেনে এনেছেন বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে। তাছাড়াও পুরাে বই জুড়ে তাঁদের কিছু উক্তি এবং কবিতার লাইনে পরিপূর্ণ ছিল ।
এছাড়াও বইয়ের শেষ পর্যায়ে রুদ্রের চিঠিতে কী এমন লেখা ছিল তা নিয়ে রহস্য রয়েই গেলো। এক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ স্যার এর লেখার ধরণের মত জুনায়েদ ইভানও একটা রহস্য রেখে দিয়েছেন পাঠকদের ভাবনার জগতে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য। যা পাঠকদের ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খাওয়াবে বলেই আশা করি।
ব্যাক্তিগত মতামত
প্রতিটি লেখক ই তার লেখনীর মাধ্যমে সমাজে এক বা একাধিক বার্তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেন। জুনায়েদ ইভানও এ বইটির মাধ্যমে জীবনের উপলব্ধি নামক বিষয়টির পাশাপাশি পরিস্থিতিভেদে সিদ্ধান্ত ও তার সাথে মানিয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলাসহ বিভিন্ন বার্তা বহন করেছে বলে আমি মনে করি। বইটি পড়ে আমি নিজেও মুগ্ধ হয়ে গেছি। প্রতিটি পাতায় পাতায় যেনো জীবনের রহস্য, জীবনের মর্ম লেপ্টে আছে।
উপসংহার
বইটি পড়ে পাঠকগণ ইভান ভাইয়ের পরবর্তী বইয়ের জন্য মুখিয়ে থাকবেন এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কোনো লেখকের প্রথম বই এতটাও দারুণ হতে পারে এ বইটি না পড়ে বোঝার উপায় নেই। গায়ক জুনায়েদ ইভান ভাল লেখেন তা তার ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকেই আঁচ পাওয়া যায় তবে তার এ বইটি এতটা দারুণ হবে তা অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেনি। গায়ক জুনায়েদ ইভানের মতো লেখক হিসেবেও এগিয়ে যাক অনেকটা পথ সাথে এগিয়ে নিয়ে যাক আমাদের সমাজ এবং সাহিত্যকে। শুভকামনা রইলো লেখক জুনায়েদ ইভানের জন্য।
এক নজরে বই;
বই: শেষ
ধরণ: সমকালীন উপন্যাস।
লেখক: জুনায়েদ ইভান।
প্রচ্ছদ: সঞ্চিতা সৃষ্টি।
মলাট মূল্য: ৩৫০/-
প্রকাশনী: কিংবদন্তী।

জন্ম কুমিল্লায়। আব্দুল্লাহেল মুহিত ও আঞ্জুমান নাহারের বড় ছেলে। কুমিল্লার জেলার দেবিদ্বার উপজেলার দুয়ারিয়া গ্রামে বাড়ি। গাছ-গাছালির ছায়ায়, লতাগুল্মের সাথে বড় হওয়া। পাখি ও ফড়িংয়ের পেছনে ছুটে আর ছিপ-নাটাই হাতে কেটেছে শৈশব। তবে কৈশোর কেটেছে নাগরিক শহর ঢাকায়। পড়ালেখার হাতেখড়ি মায়ের কাছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় ‘কুমিল্লা পলিটেকনিক্যাল কোয়ার্টার স্কুলে’। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত নিজ গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়া হয়। পরে পাশের গ্রামের মাদরাসায় পড়া শুরু। পাঠের শেষ হয় ঢাকায়। লেখালেখি শুরু ছড়া-কবিতা দিয়ে, তবে থিতু হওয়া গল্প-উপন্যাসে। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও কাব্যচর্চা বাদ পড়েনি। ভিন্ন ভিন্ন লিটলম্যাগে লেখা প্রকাশ হলেও বনে-বাদাড়ে কিশোর দল প্রকাশিত প্রথম বই। আওয়ার ইসলাম নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করা হয় পাঁচ বছর। চলমান সময়ে নতুন কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত সময় পার হচ্ছে।