তুরস্কে যেভাবে নির্বাচন হয়

তুরস্ক। সরকারি নাম প্রজাতন্ত্রী তুরস্ক। পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। দলীয় সরকারের অধীনেই তুরস্কে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমি এখানের ছয়টি নির্বাচন দেখেছি, কোনো নির্বাচন নিয়েই কথা উঠেনি। গতবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে কেউ কেউ কথা উঠাতে চেয়েছিল কিন্তু বিরোধী জোটের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী স্বয়ং নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে মর্মে বিবৃতি দিয়ে যেকোনো শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছিল। প্রশ্ন হল, এমন কি পদ্ধতি তুরস্কের আছে যাতে সবাই আস্থা রাখতে পারে। আমার কাছে দুটো বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়:

তুরস্কে যেভাবে নির্বাচন হয়:
বর্তমানে তুরস্কে একই দিনে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের অন্যতম প্রধান নিয়ম হলো, কোন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দু’জনের মধ্যে দ্বিতীয় দফা ভোট গ্রহণ হবে। এ ভোট গ্রহণটি অনুষ্ঠিত হবে ঠিক ১৫ দিন পরে।

তুরস্কের ‘প্রেসিডেন্ট’ পদের ক্ষমতায়ন:
২০১৮ সালে রজব তাইয়্যেব এরদোগান প্রধানমন্ত্রীর অফিস অবলুপ্ত করে দেন ও প্রেসিডেন্টের হাতে প্রায় সব ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত করেন। এতে প্রেসিডেন্ট পদটি আরো ক্ষমতাশালী হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে প্রেসিডেন্ট নিজে ডিক্রি জারি করতে পারবেন, মন্ত্রী ও বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা পান।

বিরোধী দলগুলো যে পরিকল্পনা করছে:
‘টেবিল অফ সিক্স’ নামে পরিচিত বিরোধী দলগুলির পরিকল্পনা হলো ২০১৮ সালের মতো এবার তারা আলাদা আলাদা প্রার্থী দেবে না। এবার তারা যৌথভাবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত করবে। নির্বাচনে জয়ী হলে তারা ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব আনবে ও ক্ষমতার একত্রীকরণকে দূর করবে।

বিরোধী দলগুলোর দাবি:
বিরোধী দলগুলোর দাবি করেছে, সম্প্রতি তুরস্কের অর্থনীতিতে যে প্রবল চাপ তৈরি হয়েছে তা মূলত এরদোগান কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের জন্য। তার আমলে তুরস্কের নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়েছে। এরদোগান তুরস্কের বিচার বিভাগকে ছিনতাই করেছেন। পাশাপাশি পশ্চিমের সাথে তুরস্কের সম্পর্ককে ধ্বংস করেছেন এছাড়াও তিনি তুরস্কে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

বিরোধী দলীয় জোটের সমস্যা :
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে এরদোগানের সমর্থক ও বিভিন্ন বিরোধী দলীয় জোট গুলা প্রায় সমানভাবে বিভক্ত। তবে বিরোধী দলীয় জোটগুলো কোন একক নেতাকে ঘিরে একত্রিত হতে পারেনি। আর এটা সম্ভব না হলে আসন্ন নির্বাচনে এরদোগানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হবে না।

তুরস্কে রজব তাইয়্যেব এরদোগানের উত্থান:
২০০৩ সাল থেকে তুরস্কের রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন এরদোগান। ২০০২-২০০৩ সংসদ নির্বাচনে এরদোগানের একে পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় ও এরদোগান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১১ বছর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০১৪ সালে তুরস্কে অনুষ্ঠিত প্রথম সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হন। এর পর থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এরদোগান।

ক্ষমতায় এরদোগানের টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ :
গত ২০ বছর ধরে তুরস্কের দায়িত্ব পালন করে আসছেন এরদোগান। দুই দশকের মধ্যে বর্তমানে তিনি সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছেন বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।

কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের দামবৃদ্ধির কারণে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে এরদোগানকে। অথচ বর্তমান অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা বলেই জানিয়েছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্যাস মজুদ আছে তুরস্কে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা-ওইসিডি দেশসমূহের মধ্যে দ্রুত উন্নয়নশীলতার দিক থেকে দেশটি দ্বিতীয়তে অবস্থান করছে। তাছাড়া ২০২২ সালে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মোট ২.৭ বিলিয়ন কিলোওয়াট ও বায়ু খামার থেকে ৪.২ বিলিয়ন কিলোওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে যা রেকর্ড সমতুল্য। তুরস্কের মোট বিদ্যুৎ ইনস্টল করার ক্ষমতা বর্তমানে ১০০,০০০ মেগাওয়াট অতিক্রম করেছে।

তুরস্কের নির্বাচনে পশ্চিমা নেতাদের অবস্থান:
নিঃসন্দেহে পশ্চিমা নেতারা এরদোগানের পরাজয়ে খুশি হবেন। কারণ তিনি রাশিয়ার কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অর্জনের মাধ্যমে ন্যাটোর নিরাপত্তাকে ক্ষুণ্ন করেছেন। কৃষ্ণসাগরে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাপক প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার হওয়ার পরে তুরস্ক একটি জ্বালানি বিতরণ কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার জন্য রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার অনুসরণ করেছে। সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সদস্যপদ অবরুদ্ধ করে ন্যাটো জোটকে হতাশ করেছেন।

শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ইউরোপের সাথে মারাত্মক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলিতে গ্রিসের দিকে ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহী বক্তব্য ছুঁড়েছেন। এছাড়াও ওয়াশিংটনের সাথে আঙ্কারার সম্পর্ক বর্তমানে উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারন তুরস্কের শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এরদোগানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন।

আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব বহন করে এমন বেশ কিছু নির্বাচন রয়েছে চলতি বছরে। যার মধ্যে সম্ভাব্য ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে নাইজেরিয়ার নির্বাচন। এছাড়াও অক্টোবরে রয়েছে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি নিঃসন্দেহে ঘটতে চলেছে এ বছরের ১৪ মে। যে নির্বাচনে রজব তাইয়্যেব এরদোগান তুরস্কের উপর তার শাসন ব্যবস্থাকে তৃতীয় দশকে প্রসারিত করার চেষ্টা করবেন। আর এই নির্বাচনের ফলাফলটিই ওয়াশিংটন, মস্কো, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকার ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকেই অঙ্কন করবে।

সূত্র: আল জাজিরা, আরব নিউজ পাকিস্তান