ডেস্ক:
অধিকাংশ বাঙালীর নামের শেষে পদবী থাকে। এটি হতে পারে উপাধি, উপনাম কিংবা বংশসূচক নাম। বাঙালির পদবীর এই ধারা খুব দীর্ঘ নয়। মধ্যযুগে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফলে পরবর্তীতে বৃটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমান্তরালে পদবীর বিকাশ ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়। পালদের আমল থেকে সেন যুগ, তারপর সুলতানি আমল থেকে ব্রিটিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে পদবীগুলো থিতু হয়েছে বলে ধরা হয়। পদবীর সঙ্গে পেশা, বসতিস্থানের যোগই বেশি। জমিজমা আর হিসাবের সঙ্গে জড়ানো পদবীর সংখ্যাও কম নয়। বল্লাল সেনের আমলে যেমন ৩৬টি জাত সৃষ্টি করা হয়েছিল। সবগুলোর সঙ্গে পেশা আর গুণ যুক্ত। বংশ পদবী নিয়ে সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা কম নয়, অসুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে সহস্রগুণ।
পদবীর ধারণাটা জন্মাল যেভাবে
শৈশব থেকে পদবীর সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা গড়ে ওঠে বলেই এমনিতেই ধারণা হয়ে যায় যে, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই পদবী অত্যন্ত প্রাচীন। পদবী কিন্তু টাকা দিয়েও কেনা হয়েছে অনেকবার। কেউ আবার এর গায়ে চড়িয়েছেন সংস্কৃতের প্রলেপ। কোর্টে গিয়ে এফিডেভিট করার ঘটনা সাম্প্রতিককালেও ঘটেছে অনেক। দাশগুপ্ত বা সেনগুপ্তের মতো যুগ্মপদবী কিন্তু রীতিমতো আধুনিক।
আবার জাতি হিসাবে বাঙালী হওয়ায় আমাদের কতই না গর্ব, অথচ হরিয়ানায় বাঙালী একটি তফসিলি জাতি। আবার অনেক পদবী একাধিক জাতিতেও প্রচলিত যেমন নন্দী, কুন্ডু, পাল বা দাস। এগুলো বর্ণহিন্দু জাতির মধ্যেই দেখা যায়। আবার কায়স্থদের মধ্যেও প্রচলিত। নন্দী যেমন ব্রাহ্মণদের একটি আদি পদবী। মাঝি বা মাজি বর্ণহিন্দুদের পদবী। ব্রিটিশ আমলে কোম্পানির মুনশিকেও মাঝি বলা হতো। নদী পারাপারকারী ব্যক্তিদের তো মাঝি বলাই হয়। অনেক গাঞি মানে গাইয়া নাম যে পদবী হিসাবে ব্যবহৃত হয় তার নজির কিন্তু এখনো আছে , যেমন বটব্যাল, কুশারী, ভট্টশালী ইত্যাদি।
মোগল ও অন্যান্য মুসলিম শাসনামলে বাঙালি মুসলমানদের নামেও যুক্ত হয়েছে নানা পদবী— ভূঁইয়া, তালুকদার, মুন্সী, বেপারী, বাহাদুর, লস্কর, সর্দার, দেওয়ান, দফাদার, হাওলাদার, মহুরী, খোন্দকার, মাতবর, সওদাগর, খলিফা, সৈয়দ, পাটোয়ারী ইত্যাদি।
খ্রিস্টান সমাজে পদবী এসেছে বিচিত্রভাবে। ডিকস্টা যেমন পর্তুগীজ ধর্মযাজকদের দ্বারা ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের বোঝায়। আবার ডি রোজারিও বোঝায় রোজারিও দ্বীপ থেকে আগত ধর্ম যাজক দ্বারা ধর্মান্তরিত ব্যক্তি। ডি মানে আসলে দ্বীপ। এবার আসা যাক কিছু নির্দিষ্ট বংশ পদবীর কথায়।
চৌধুরী: সংস্কৃত চতুধারী শব্দ থেকে এসেছে বাংলা চৌধুরী শব্দ। এর অর্থ চর্তুসীমানার অন্তগর্ত অঞ্চলের শাসক। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমিদারদের পদবী হচ্ছে চৌধুরী। আবার অনেকে মনে করেন চৌথহারী’ যার অর্থ এক চতুথাংশ রাজস্ব আদায়কারী, সেখান থেকে উচ্চারণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে চৌধুরী’। সেদিক থেকে চৌথ আদায়কারী বা রাজস্ব আদায়কারী পদ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার। বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে, চতুর’ যার অর্থ তাকিয়া বা মসনদ, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর’ (অর্থ ধারক) এবং এই দুয়ে মিলে হয়েছে চৌধরী’ আর তার থেকেই চৌধুরী’। তবে তা মূলত হিন্দী ও মারাঠি শব্দ। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে চৌধুরী বংশ পদবী ব্যবহার করা হয় এদেশে। বৃটিশ-ভারতের প্রায় সর্বত্র এ পদবীর অস্তিত্ব ছিল। কারণ চৌধুরী ছিল সামন্ত রাজার পদবী।
শেখ: শেখ সোজা আরবী থেকে আসা পদবী। এ দিয়ে সম্ভ্রান্ত মুসলমানদেরই বোঝায়। আরবদেশে গোত্র প্রধান বা গোত্রের বয়স্ক লোকদের শেখ বলে ডাকা হয়। নবীজি সা. যাকে বা যাদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন তিনি বা তাদের বংশধরও শেখ পদবী লাভ করতেন। বাংলাদেশের শেখরা অবশ্য ধারণা পোষণ করেন না যে তাদের পূর্ব পুরুষ সৌদী আরব থেকে এসেছে। অধিকাংশ সৈয়দরা যেমনটি করে থাকেন। তবে নেপথ্যে কিন্তু ওই একই চেতনা। নবীজির হাতে মুসলমান না হলেও বাংলায় ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে যারা নতুন ধর্মকে গ্রহণ করে নেন, প্রাচীন ও মধ্যযুগে তারা শেখ পদবী ধারণ করে ছিলেন। এমনিতেও কিন্তু অন্য ধর্মের লোকেরা মুসলমান বলতে শেখ বা সেক বুঝে থাকেন।
বিশ্বাস: বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এ পদবী অনেক দেখা যায়। কায়স্থরাই বেশি ব্যবহার করে। নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের মধ্যেও এর প্রচলন দেখা যায়। মুসলমান ও খ্রিস্টান বাঙালির মধ্যেও আছে কিছু। বিশ্বাসের অর্থ আস্থা বা বিশ্বস্ততা। বাংলা মুলুকে সরকারি প্রশাসনিক পরিষেবায় যারা অবদান রেখেছেন তাদের পদবী বিশ্বাস। মানে প্রাপ্তি এবং ব্যয়ের কাজে নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সম্মানিত করতে এ উপাধি দেওয়া হয়েছিল।
দাস বা দাশ: গবেষকরা মনে করেন দাশ যারা লেখেন তারা এসেছেন ধীবর সম্প্রদায় থেকে। কবি জীবননান্দ দাশের কথা এখানে মনে পড়ছে। ওদিকে ভারতের উড়িষ্যার বৈদিক ব্রামহণরা দাবী করেন তারা দশসংস্কার নৈপুণ্যে দাশ উপাধি পেয়েছিলেন। অন্যদিকে দাস এসেছে ভৃত্যশ্রেণী থেকে। কিন্তু অযোধ্যার পুরোহিতরা এটা মানতে নারাজ। তারা নিজেদের বলেন ভগবানের দাস। আরেকটু খতিয়ে দেখলে, ভারতে জেলেদের পদবী হলো জলদাস আর মুচিদের রবিদাস। সেক্ষেত্রে নিম্নবর্গের প্রসঙ্গটি আবার সামনে আসে। বেনী মাধব দাস ব্রিটিশ ভারতের একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। শরৎচন্দ্রবসুসহ আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির গুরু তিনি।
ফকির: মুসলমানদের পদবীটি এসেছে সন্ন্যাসবৃত্তি থেকেই। মরমী সাধকরা ফকির পদবী গ্রহণ করতেন। আরবী এ শব্দের অর্থ নিঃস্ব। দরবেশ যারা এদেশে এসেছিলেন তারা ফকির নামেই পরিচিতি পেয়েছেন। এছাড়া বিশেষ কোনো ধর্মেও অনুসারী না হয়ে যার সকল ধর্মেও মূলনীতি নিয়ে আত্মতত্ত্ব সন্ধান করেন তাদের পদবী ফকির। আবার সুফি বা বাউল তত্ত্ব বিশ্বাসীরাও ফকির।
তালুকদার: খুব পরিচিত একটি পদবী আমাদের দেশে। মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব ও ভূমি সংক্রান্ত বিষয়াদি থেকে যেসব পদবীর উৎপত্তি তার মধ্যে তালুকদার অন্যতম। তালুক শব্দটি থেকেই এর ভিতরের কথা টের পাওয়া যায়। আরবি শব্দ তা’আল্লুকের অর্থ হচ্ছে ভূ-সম্পত্তি আর এর সঙ্গে যুক্ত হলো ফারসি দার। আসলে যিদি তালুকদার তিনি জমির বন্দোবস্ত নিতেন সরকারের কাছ থেকে যেমন, তেমনি জমিদারের কাছ থেকেও। ফলে তিনি হতেন উপজমিদার, তালুকদার এসেছে সে অর্থেই।
মণ্ডল: এটি বেশ পুরোনো পদবী ধারণা করা চলে। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজেই এর প্রচলন দেখা যায়। সাধারণভাবে অনানুষ্ঠানিক গ্রাম-প্রধানকেই মণ্ডল বলা হয়। তারা আগে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। মন্ডলীয় কাজ করে তারা অনেক অধিকার ভোগ করতেন। খাজনা আদায়কারী ও রায়তদের মধ্যস্থতা করা অথবা গ্রামীণ বিবাদ আপোস মীমাংসা করতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতেন। তাদের অধীনেক পাটোয়ারি, তহসিলদার, চৌকিদাররাও কাজ করতেন। সরকার ও প্রজাদের মধ্যকার মানুষ আসলে মণ্ডল।
বসু: সম্ভ্রান্ত হিন্দু বাঙালি পদবী বসু। সংস্কৃত বাসু থেকে এর উৎপত্তি। এটি বিষ্ণুর একটি নাম যার অর্থ সবের মধ্যেই বসবাস। অনেকে আবার একে মহাদেব বা শিবেরও এক নাম বলে উল্লেখ করেছেন। বাসু শব্দের সঙ্গে সম্পদ, রত্ন ইত্যাদিরও যোগ আছে। মূলত কায়স্থরা এ পদবীর অধিকারী। পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকে বাংলায় কায়স্থদের উত্থান। তারা গৌতম গোত্রের কুলীন কায়স্থ, ঘোষেরা, মিত্ররা আর গুহরা যেমন। কলকাতার বাগবাজারের বসুবাটি খুব বিখ্যাত। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু এই বাড়ির সন্তান। শ্রী রামকৃষ্ন নন্দলালের সংগৃহীত দেবতাদের ছবি দেখতে এ বাড়িতে এসেছিলেন ।
সেন: সংস্কৃত সেনা থেকে সেন পদবী এসেছে বলেই বেশিরভাগের মত। ইংরেজ আর্মিকে আমরা বাংলায়ও সেনা বলছি। এটা আসলে সংস্কৃত শব্দ। ব্রাহ্মন রাজপুরুষরা সেন পদবটি প্রথম গ্রহণ করেন। নিজেদের তারা উঁচুজাতের ক্ষত্রিয় দাবী করতেন। মজার ব্যাপার হলো সেন পদবীধারী লোক সুইজারল্যান্ডেও মেলে। চীনেও সেনরা আছেন। তবে বানান লেখা হয় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। চীন প্রজাতন্ত্রেও প্রথম রাষ্ট্রপতি সান ইয়াত সেনকে অনেকেই চিনবেন। তিনি মাঞ্চু রাজবংশের অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
ঠাকুর: বাংলা শব্দের বিশেষজ্ঞ হরিচরণ বন্দ্যোপধ্যায়ের মতে- ঠাকুর শব্দের মূল হচ্ছে (সংস্কৃত) ঠাক্কুর’ তার থেকে > (প্রকৃত) ঠকুর > (বাংলা) ঠাকুর এসেছে। পদবীগত দিক থেকে তা ব্রাক্ষণের পদবী বিশেষ, এমনকি ক্ষত্রিয়েরও উপাধি এটি। মধ্য যুগের কাব্য চৈতন্য ভাগবত’ উদ্ধৃত করে লেখক বলেছেন, তা বৈঞ্চবেরও উপাধি। যেমন, হরিদাস ঠাকুর। পাচক ব্রাক্ষণও এক প্রকার ঠাকুর বলে পরিচিত। তবে আহমদ শরীফ সম্পাদিত সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান’ বলছে, সংস্কৃত ঠক্কুর থেকে ঠাকুর আসলেও এর মূলে ছিল তুর্কী শব্দ। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয়েই এই পদবী ব্যবহার করে। এরকম শতাধিক বংশ পদবী বাঙালির ইতিহাসে যা বৈচিত্রময় পথ ও মতের এক অসাধারণ স্মারক হিসেবে চিহিৃত।
এমন অনেক পদবী ধরে আছে বাঙালি। খান, মোগল, পাঠান, গাজী, কাজী কিন্তু সরাসরি বিদেশি পদবী। খান পদবী যেমন আফগান মুল্লুক থেকেই এসেছে। চেঙ্গিস খানের সঙ্গেও একে জড়ান অনেকে। হাজরা, হাজারী, মোড়ল, মল্লিক, সরকার, পোদ্দার কিন্তু জমি-জমা বিষয়ক পদবীই। ওদিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় আর মুখোপাধ্যায় কিন্তু কতগুলি গ্রাম গোত্র থেকেই এসেছে। যেমন বন্দ্যঘটি গ্রামের কুলীন ব্রাহ্মনহরা শুরু করেছিলেন বন্দ্যোপাধ্যায় পদবীর। আবার চটুতি বা চট্ট থেকে উদ্ভুত চট্টোপাধ্যায়। গাঙ্গুর বা গঙ্গ গ্রামের বসতি থেকে এসেছে গঙ্গোপাধ্যায় এবং মুকুটি বা মুখটি অঞ্চলের বসতি থেকে ছড়িয়েছে মুখোপাধ্যায়। এছাড়া বাদর গ্রাম থেকে ভাদুড়ী পদবীর জন্ম।

জন্ম কুমিল্লায়। নিউজ পোর্টাল আওয়ার ইসলামে সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করেছি পাঁচ বছর। চলমান সময়ে নতুন কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত সময় পার হচ্ছে।