আর্থ্রাইটিস বা বাতের রোগীরা হাঁটু, গোড়ালি, পিঠ, কব্জি বা ঘাড়ের জয়েন্টগুলিতে ব্যথায় ভোগেন। এই রোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ৫০ বছরের পরে মানুষের মধ্যে দেখা দেয়। তবে বর্তমান সময়ে জীবনযাত্রায় অনিয়মের কারণে তরুণরাও এর শিকার হচ্ছে।
বাত কি?
বাত বা আর্থ্রাইটিস একটি সিস্টেমিক ডিজিজ অর্থাৎ যা কিনা পুরো শরীরে প্রভাব ফেলে। অস্থিসন্ধিতে ইউরিক এসিড জমা হয়ে এ রোগের উৎপত্তি হয়। মূত্রের মাধ্যমে যে পরিমাণ স্বাভাবিক ইউরিক এসিড বেরিয়ে যায়, তার থেকে বেশি পরিমাণ ইউরিক এসিড যখন আমাদের যকৃৎ তৈরি করে তখনই তা রক্তের পরিমাণ বাড়ায়।
অথবা খাবারের মাধ্যমে বেশি পরিমাণ ইউরিক এসিড শরীরে প্রবেশ করলে এবং কিডনি রক্ত থেকে যথেষ্ট পরিমাণে তা ফিল্টার করতে না পারলে বাতের উপসর্গগুলো দেখা দেয়।
বাত হলো একটি অটোইমিউন ব্যাধি। মানে এতে আপনার রোগ প্রতিরোধ সিস্টেম বা ইমিউন সিস্টেম আপনার জয়েন্টগুলোকে আক্রমণ করে। এর ফলে জয়েন্টে বা গিরায় গিরায় ব্যথা, লালভাব, ফুলে যাওয়া এবং প্রদাহ হয়।
বাতের কারণ
অস্থিসন্ধিতে ইউরিক এসিড জমার কারণেই বাত হয়ে থাকে। শতকরা ২০ ভাগেরও বেশি রোগীর ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাতরোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে।
এ ছাড়া স্থূলতা, ডায়াবেটিস, কিডনির রোগ, সিকল সেল এনিমিয়া (এক ধরনের রত্তস্বল্পতা), নিয়মিত অ্যালকোহল পানের কারণেও শরীরে ইউরিক এসিড বেড়ে গিয়ে বাতের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বাতের লক্ষণ
বাতের প্রাথমিক লক্ষন হলো ব্যথা। শরীরের বিভিন্ন জায়গাতে লালচে ভাব দেখা দেয়। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন জায়গাতে ফুলে যাওয়া বা মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়াও বাতের লক্ষণ। জয়েন্টের চারপাশে অস্বাভাবিক অবস্থা হয়ে যায় এবং জয়েন্টের স্থানে উষ্ণ গরম অনুভব হয়।
পায়ের গিরার জোড়া আক্রান্ত হয় এবং অত্যাধিক ব্যথা হয়। অল্প অল্প জ্বর থাকে অনেক ক্ষেত্রে। ব্যথা কমে যাবার পর আক্রান্ত স্থান ফুলে যায়। হাঁটুর জোড়া, পায়ের গোড়ালি, নখের জোড়া, হাতের কব্জি, কুনুই প্রভৃতি স্থানে প্রবল ব্যথা অনুভব করা।
বাতের চিকিৎসা
বাতের চিকিৎসা হিসেবে ফিজিওথেরাপি সঠিক বিকল্প। বাত একটি প্রোগ্রেসিভ রোগ, এটি চলতেই থাকে শরীরের ভেতর। তাই সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা প্রয়োজন। তা না হলে অন্য জটিলতা দেখা দিতে পারে।
বাতের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় কিছু লাইফস্টাইল পরিবর্তন প্রয়োজন। যেমন ওজন বেশি থাকলে কমাতে হবে। মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে বাদ দিতে হবে। প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার, যেমন মাছ, মাংস ডিম, শিমের বিচি, কলিজা ইত্যাদি খাওয়া যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে।
যেসব রোগের কারণে গিঁটে ব্যথা হয়, সেসব রোগের যথাযথ চিকিৎসা করাতে হবে। কিছু ওষুধ দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া ঘরোয়া যেসব পদ্ধতি রয়েছে সেগুলো হল,
ম্যানুয়াল থেরাপি
ফিজিওথেরাপিস্ট তার হাত দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে এবং জয়েন্ট এবং পেশীতে শক্ত হওয়া থেকে মুক্তি দেয়। এটি ব্যথা কমাতে এবং গতির পরিসীমা প্রসারিত করতে সাহায্য করতে পারে।
ব্যায়াম
সাধারণভাবে, ব্যায়াম শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ভাল বলে মনে করা হয়। তবে আর্থ্রাইটিসে, বিশেষ এবং স্থিতিশীল ব্যায়াম যৌথ শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে।
তাপ থেরাপি
তাপ থেরাপি ব্যথা এবং মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া কমাতে সাহায্য করে। একটি বোতলে হালকা গরম পানি নিয়ে, কাপড় গরম করে বা হট ব্যাগগুলো ব্যবহার করে তাপ থেরাপি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
কুলিং থেরাপি
কুলিং থেরাপি ব্যথা এবং ফোলা কমাতে সাহায্য করে থাকে। এটি আইস প্যাক, কোল্ড কম্প্রেস বা ক্রায়োথেরাপির আকারে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
অর্থোপেডিক
স্প্লিন্ট এবং ব্রেসের মতো কিছু ডিভাইস আপনার জয়েন্টগুলোকে বিশ্রামে রাখতে পারে। ফলে এগুলোর সাহায্যে বাতের ব্যথাও কমতে পারে। তবে এগুলো ব্যবহারের মাঝে বিরতি নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ব্যথা অবস্থায় হাঁটাচলা বা কাজ করার জন্য প্রয়োজনে হাতের লাঠি বা ক্র্যাচ ব্যবহার করতে পারেন। এতে ব্যথার স্থানে চাপ কম পড়বে।
বাতের রোগীরা যা খাবেন না
খাদ্যাভ্যাসের উন্নতি ঘটিয়ে এটি এড়ানো যায়। বাতের রোগীদের এসব খাবার থেকে দূরে থাকা উচিত,
১. চিনি
আর্থ্রাইটিস রোগীদের খাবারে মিষ্টির পরিমাণ কমানো উচিত। বিশেষ করে অতিরিক্ত চিনি কমাতে হবে। ক্যান্ডি, সোডা, আইসক্রিম এবং বারবিকিউ সসের মতো জিনিসগুলিতে অতিরিক্ত চিনি থাকে। ২১৭ জনের উপর পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, মিষ্টি সোডা এবং অন্যান্য মিষ্টি আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ আরও বাড়িয়ে তোলে।
২. প্রক্রিয়াজাত খাবার
প্রক্রিয়াজাত খাবার- যেমন ফাস্ট ফুড, শস্য এবং বেকড খাবারে মিহি শস্য, যোগ করা চিনি, প্রিজারভেটিভের মোট জিনিস থাকে যা, শরীরে প্রদাহ বাড়ায় এবং আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণা দেখায় যে, প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া দ্রুত স্থূলতা বাড়ায়। ফলে আর্থ্রাইটিসও বাড়তে থাকে।
৩. গ্লুটেন ফুড
গম, বার্লি এবং রাইতে গ্লুটেন প্রোটিন পাওয়া যায়। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই জিনিসগুলি আর্থ্রাইটিস বাড়াতে কাজ করে। এ ছাড়া গ্লুটেন মুক্ত খাবার বাতের লক্ষণগুলি কমাতে কাজ করে। একটি সমীক্ষা অনুসারে, গ্লুটেন ফ্রি এবং নিরামিষভোজীদের মধ্যে আর্থ্রাইটিস রোগ খুব কম পাওয়া গেছে।
৪. অ্যালকোহল
অ্যালকোহল, আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি ও লক্ষণ বাড়িয়ে তুলে। আর্থ্রাইটিস রোগীদের জন্য অ্যালকোহল পান একেবারেই নিষিদ্ধ। একটি সমীক্ষা অনুসারে, অ্যালকোহল স্পন্ডিলাইটিস আর্থ্রাইটিসে আক্রান্তদের মেরুদণ্ডের কাঠামোগত ক্ষতি করে।
৫. অতিরিক্ত লবণ
যাদের বাত আছে, তাদের লবণ কম খাওয়া উচিত। চিংড়ি, টিনজাত স্যুপ, পিৎজ্জা, পনির, প্রক্রিয়াজাত মাংস এবং অন্যান্য অনেক প্রক্রিয়াজাত খাবারে প্রচুর পরিমাণে লবণ থাকে। ইঁদুরের উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ইঁদুর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লবণ খায়, তাদের মধ্যে গুরুতর আর্থ্রাইটিস দেখা যায়। একই সময়ে, উচ্চ সোডিয়ামযুক্ত খাবার খেলেও আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
৬. কিছু উদ্ভিজ্জ তেল
ওমেগা ৬ ফ্যাট বেশি এবং কম ওমেগা ৩ চর্বিযুক্ত খাবার অস্টিও আর্থারাইটিস এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। যদিও এই চর্বিগুলি স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে তাদের দুর্বল অনুপাত শরীরে প্রদাহ বাড়ায়।
৭. প্রক্রিয়াজাত রেড মিট
কিছু গবেষণায় জানা গেছে যে, লাল এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস শরীরে প্রদাহ বাড়ায়, যা বাতের উপসর্গ বাড়িয়ে দিতে পারে। রেড মিটে ইন্টারলিউকিন-৬, সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন এবং হোমোসিস্টাইন বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। আর্থ্রাইটিস রোগীদের জন্য এটি বিপজ্জনক। ২৫,৬৩০ জনের উপর পরিচালিত একটি সমীক্ষায়, রেড মিট খাওয়া লোকদের বেশিরভাগেরই আর্থ্রাইটিস পাওয়া গেছে।
