ভারতবর্ষে যেভাবে এলো ইসলাম

আব্দুল্লাহ আফফান।।

প্রথম নবী ও মানুষ হযরত আদম আ.কে আল্লাহ তায়ালা জান্নাত থেকে দুনিয়ায় পাঠান। প্রাচীন ভারতের সিলনে তাঁকে পাঠানো হয়। (অবশ্য এ বিষয়ে একাধিক মত রয়েছে।) তাই অনেক মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক দাবি, ভারত পৃথিবীর প্রথম মুসলিম অঞ্চল। হযরত আদম আ. এর মাধ্যমেই মানুষের বংশবিস্তার হয়। ইসলামে নবুয়তের ঐতিহাসিক ধারা তাঁর মাধ্যমেই শুরু হয়। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আরবের মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন শেষ নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা. । ৪০ বছর বয়সে তিনি আল্লাহর তরফ থেকে নবুওয়াত লাভ করেন। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইসলামের দাওয়াত দেয়া শুরু করেন।

ভারতবর্ষে ইসলাম এলো যেভাবে
ইসলামের ভারত বিজয়ের পূর্বেই দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগে আরব ব্যবসায়ীদের ভারতে আগমনের সূত্র ধরে ভারতবাসী ইসলাম সম্পর্কে অবহিত হন। আরব ও উপমহাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অবশ্য আরবে ইসলামের প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই বজায় ছিল। বিভিন্ন ধরনের মসলা, উন্নত মানের কাপড়, সুগন্ধি ও কাঁচামালের জন্য তারা অহরহ এ উপমহাদেশে আসত।

বানিজ্যের হাত ধরেই মুসলিম ধর্মপ্রচারক, সুফি-সাধকরা এদেশে আসেন। তাদের কারণে শান্তির ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে উপমহাদেশের মানুষ জানতে পারে।  ধর্মপ্রচারক, সুফি-সাধকদের সুমহান চরিত্র ও মানবতাবাদী কাজে মুগ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে হিন্দু বর্ণবাদী শ্রেনী বৈষম্যে নিষ্পেষিত মানুষরা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তারা ইসলাম ধর্মগ্রহণ না করলেও তারা মানসিকভাবে ইসলামকে সর্মথন করছিল। ধর্মপ্রচারকগণ শাসক না হয়েও একে এলাকায় নিজেদের আদর্শিক প্রভাব ছিল। ক্রামান্বয়ে তারা মানুষকে ইসলামের দীক্ষায় দীক্ষিত করেন।

উপমহাদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা
সেযুগে মালাবার অঞ্চলের বন্দরগুলিতে আরব ব্যাবসায়ীদের প্রায়শই যাতায়াত ছিল। এই বন্দরগুলি ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরগুলির প্রধান যোগসূত্র। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ প্রথম মুসলমান পর্যটকরা নৌপথে ভারতীয় উপকূলভাগে অবতরণ করেন। সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে আরব মুসলমানরা প্রথম ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আরব জাতি বিশ্বের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক শক্তিতে পরিণত হয়। এরপর আরব ব্যবসায়ীরা বিশ্বের সর্বত্র ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।

উপমহাদেশের যেসব অঞ্চলে প্রথম ইসলামের আলো ছড়ায়
মালাবারের মাপ্পিলা সম্প্রদায়ই সম্ভবত প্রথম ভারতীয় ধর্মান্তরিত মুসলমান সম্প্রদায়; কারণ এই সম্প্রদায়ই আরব বণিকদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করত। এই সময় সমগ্র উপকূল জুড়ে ব্যাপক প্রচারকার্য চালানো হয় এবং বেশ কিছু স্থানীয় অধিবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই সকল নব্য ধর্মান্তরিতেরা মাপ্পিলা সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছিলেন। আরব বণিকদের সঙ্গে এই সম্প্রদায়ের বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপিত হয়েছিল।

এছাড়াও নিজ নিজ অঞ্চলে ধর্মপ্রচারক, সুফি-সাধক প্রভাব ছিল। তাদের অনুপম আদর্শে মুগ্ধ স্থানীয় জনগন। পরে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বিশেষ করে উপমহাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে সর্বাগ্রে ধর্মপ্রচারক, সুফি-সাধকদের আগমন ঘটে। তারমধ্যে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ঢাকার উপকূলীয় অঞ্চল, রংপুর এবং ভারতের দক্ষিণাত্যের এলাকা সমূহ, মুলতান, আহমদাবাদ, পাঞ্জাব ও সিন্ধু। এছাড়াও সিন্ধুর নিকটবর্তী অঞ্চল— দেবল, মানসুরাহ, খোজ্জদার এলাকায় তাদের বসতি গড়ে উঠে ছিল। এসব এলাকায় ইসলাম প্রচার, মসজিদ, খানকাহ নির্মাণ এবং ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে তারা ব্যাপকভাবে মনোনিবেশ করেন।

ভারতের প্রথম মসজিদ
৬২৯ সালে হযরত মুহাম্মদ সা. (৫৭১–৬৩২ খ্রি.) এর জীবদ্দশাতেই ভারতে প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয়। চেরামন পেরুমল নামে নবমুসলমানের নির্দেশে কেরলের ত্রিশূর জেলায় মালিক বিন দিনার এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য, পেরুমলকেই প্রথম ভারতীয় মুসলমান মনে করা হয়।

শাসক রূপে মুসলিমদের ভারত আগমন
ঐতিহাসিক সূত্রে যতটুকু জানা যায়, হযরত ওমর রা. কতৃক পারস্য বিজয়ের পর উপমহাদেশীয় অঞ্চলের দিকে মুসলিমরা নজর দেয়। তখন থেকে মুসলিমরা ভারত অভিযানের চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। হযরত ওমর রা. কর্তৃক নিযুক্ত বাহরাইন ও ওমানের শাসনকর্তা প্রখ্যাত সাহাবী হযরত উসমান বিন আবুল আস্ আস সাকাফী রা. এর ভাই আল হাকামকে সিন্ধুর বরুচ অঞ্চলে এবং আরেকভাই মুগীরাহ বিন আবুল আসকে দেবল অভিযানে প্রেরণ করা হয়। তারা তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের পরাস্ত করে ভারতের সীমানায় প্রথম প্রথম ইসলামের বিজয়ী কেতন উড্ডীন করেছিলেন।

পরে হযরত উসমান রা. এর শাসনামলে তার নিযুক্ত মাকরানের শাসনকর্তা উবায়দুল্লাহ বিন মামার তামিমী সিন্ধুনদ পর্যন্ত সমগ্র ভূ-ভাগ স্বীয় শাসনাধীনে আনেন। ভারতের আবহাওয়া সৈন্যদের অনুকুলে না হওয়ায় তারা আর সামনে এগোয় না। হযরত আলী রা. ও হযরত মুয়াবিয়া রা. এর শাসনামলে ভারত অভিযান করা হয়।

অষ্টম শতাব্দীতে মুহাম্মদ বিন কাশিমের নেতৃত্বে আরব বাহিনী সিন্ধু (অধুনা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধুপ্রদেশ) জয় করে। সিন্ধু উমায়া খিলাফতের পূর্বতম প্রদেশে পরিণত হয়। দশম শতাব্দীর প্রথম ভাগে গজনির মামুদ পাঞ্জাব গজনাভি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি বর্তমান ভারত ভূখণ্ডের অন্যান্য স্থানেও অভিযান চালিয়েছিলেন। তবে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আরও সফলভাবে ভারতে অভিযান চালান মুহাম্মদ ঘোরি। তার অভিযানের ফলস্রুতিতে শেষ পর্যন্ত দিল্লি সুলতানির পত্তন হয়।

বঙ্গ অঞ্চলে মুসলিমদের শাসন প্রতিষ্ঠা হয় কুতুবুদ্দীন আইবেকের সেনাপতি ইখতিয়ার বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক ১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে। অবশ্য এর বহু আগে এ অঞ্চলে মুসলিমদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এমনকি চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি ক্ষুদ্র শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল।