মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন ‘সুরা মসজিদ’

শাহ সুজা মসজিদ। মুসলিম স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন এ মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর ধরে। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ৪নং ঘোড়াঘাট ইউনিয়নের চৌরগাছা মৌজায় এ মসজিদের অবস্থান। প্রাচীন এ মসজিদের নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি এর নামকরণ নিয়েও রয়েছে নানান জনশ্রুতি। কেউ কেউ এ মসজিদকে সৌর মসজিদ বলে ডেকে থাকেন। আবার কেউ বলেন সুরা মসজিদ। কারও কাছে এ মসজিদ শাহ সুজা মসজিদ নামেও পরিচিত। একেকজনের কাছে একেক নামে পরিচিত ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটি।

মসজিদ তৈরি নিয়ে রয়েছে বেশকিছু কাহিনী

স্থানীয়দের মতে, ‘শত শত বছর আগে জিন জাতি একরাতে এ মসজিদ নির্মাণ করেছে’। তবে এর স্থাপত্যশৈলী ও কারুকার্য দেখে অনেক ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ১৬ শতকে সুলতানি আমলে হোসেন শাহীর শাসনকালে এটি নির্মাণ করা হয়। সে অনুয়াযী মসজিদটির বয়স প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর। এ মসজিদকে গায়েবি অর্থাৎ লোকচক্ষুর আড়ালে তৈরি হওয়া মসজিদ বলেও দাবি করা হয়। আবার মুরব্বিরা বলেন, মুঘল আমলে বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজা এ মসজিদ নির্মাণ করেছেন। তাই তারা একে শাহ সুজা মসজিদ বলে ডাকেন।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক দানি এটিকে গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে নির্মিত বলে অনুমান করেন। তাই মসজিদটি সুলতানি আমলে (১৪৯৩-১৫১৮) খ্রিস্টাব্দে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। মুসলিম আমলে গৌড় থেকে ঘোড়াঘাট যাওয়ার পথ ছিল একই। এ সময় মুসলমানদের নামাজ পড়ার সুবিধার জন্য খুব সম্ভব এখানে এই মসজিদ তৈরি হয়েছিল। ঘোড়াঘাটে মুসলিম আমলের পাকা ঘাটওয়ালা বিশাল দিঘির পাশেই এই সুরম্য মসজিদ।

নির্মাণ কাঠামো
মসজিদটির মূল কাঠামো ৪ ফুট উঁচু একটি প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আয়তনে বাইরে দিক থেকে উত্তর-দক্ষিণে ৪০ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২৬ ফুট। একটি বড় ও তিনটি ছোটসহ মোট চারটি গম্বুজ রয়েছে। ১৬ বর্গফুটের প্রধান কক্ষসহ পুরো মসজিদের দেয়ালে মৌলিক টেরাকোটার নান্দনিক অলংকরণ করা আছে। মসজিদটির ওপরে বর্গাকার এক গম্বুজবিশিষ্ট নামাজ কক্ষ এবং পূর্ব ভাগে ছোট তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি বারান্দা রয়েছে। চুন সুরকির সাহায্যে ছোট আকৃতির ইট দ্বারা নির্মিত মসজিদের দেয়াল ১ দশমিক ৮০ মিটার প্রশস্ত। নামাজ কক্ষের চার কোণে চারটি ও বারান্দায় দুটি কালো পাথরের মিনার রয়েছে।

মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্ব দিকে তিনটি ও উত্তর দক্ষিণে একটি খিলানকৃত প্রবেশপথ রয়েছে। বারান্দার উভয় পাশেও একটি করে প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদের ভেতরে কেবলা দেয়ালে তিনটি সুন্দরভাবে অলংকৃত পাথরের তৈরি অবতল মিহরাব রয়েছে। মসজিদের ইটের সঙ্গে পাথরের ব্যবহার, দেয়ালের মাঝে পাথরের স্তম্ভ, ইটের গাঁথুনি চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া প্রত্যেক দরজার নিচে চৌকাঠ রয়েছে। সেগুলো পাথরের তৈরি। পূর্ব পাশে মসজিদে প্রবেশের সিঁড়ি আছে। এখানকার কালো ও বেলে পাথর বাংলার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত রাজমহল থেকে আনা হয়েছে বলে মনে করা হয়।

এসব নির্মাণ ও গঠনশৈলী দেখে ধারণা করা যায়, শাহ সুজার ক্ষমতা গ্রহণের অনেক আগে এটি নির্মিত হয়েছে। যেহেতু এ মসজিদটির কোনো শিলালিপি নেই, তাই গঠনশৈলীর ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য নির্মাণকাল বের করা হয়। স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণের কলাকৌশল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ধারণা করা হয়, সুলতান হোসেন শাহর আমলের নিদর্শন এটি।

মসজিদের প্রতিবেশী
মসজিদের উত্তর পাশে ৩৫০ থেকে ২০০ গজ আয়তনের একটি দিঘি রয়েছে। দিঘির পাড়ের পশ্চিম এবং উত্তর পাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি কবর। এ ছাড়া মসজিদ এবং দিঘিরপাড়ের মাঝে আছে একটি ঈদগাহ মাঠ। মাঠের পাশে বিশাল আকৃতির পুরাতন দুটি তেঁতুলগাছ পুরো এলাকায় ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রতিবেশী মসজিদকে আরও বেশি নান্দনিক করে তুলেছে।

যেভাবে পৌঁছানো যাবে
দিনাজপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ১০৬ কিলোমিটার দূরে ঘোড়াঘাট উপজেলার ৪নং ঘোড়াঘাট ইউনিয়নের এর অবস্থান। উপজেলা পরিষদ অর্থাৎ ওসমানপুর বাজার থেকে ভ্যান অথবা অটোরিকশাযোগে ঘোড়াঘাট-হিলি রাস্তা ধরে যেতে হবে। রাস্তার ধারঘেঁষে এগুলোই এ মসজিদের দেখা মিলবে।