শান্তা নাজনীরের গল্পগ্রন্থ নেশা লাগিল রে

এস. এম তৌফিক।।

মোহিনীর গান যেন প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে চেয়ারম্যানের ছেলে সৌরভের বুকেও…..; একখন্ড “বাংলাদেশ” নিয়ে লড়তে গিয়ে কবে, কখন স্বাধীনচেতা শবনম ভীরু দিগন্তের প্রেমে পড়ে যায়, সে জানে না; আবার অত্যন্ত সুপুরুষ শরিফের গলায় গলা মিলিয়ে হিম-রক্তের পরমেশ্বরীরা বলে ওঠে- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ আবার, জেকের সাহেব কিংবা সাইম-আশরাফদের জীবনের রহস্য উদঘাটনে বেড়িয়ে পড়া অথবা গানের ম্যামের হাত ধরে জীবনে নতুন করে বাঁচতে শেখা তিন তরুণীর গল্প। নতুবা, বাপ-বেটির ভালবাসা, সুবোধ এর বুড়ো বয়সে প্রেমে পড়া, আশিকের আলোর ঠিকানার খোঁজ মিলবে কী?

এমন সব গল্পের ঝুলি কখন যে আপনার মন জয় করে হারিয়ে যাবে অজানায় তা হয়তোবা আপনি নিজেও টের পাবেন না…….!

বইটির নাম “নেশা লাগিল রে” মূলত বইটিতে থাকা প্রথম গল্পটির নামানুসারেই রাখা হয়েছে। প্রচ্ছদশিল্পী জুলিয়ান বইটির নাম অনুসারে একদম পরিপূর্ণ একটি প্রচ্ছদ করেছেন। একটি বইয়ের জন্য পাঠকসমাজ ঠিক যেরকম প্রচ্ছদ আশা করেন ঠিক তারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন প্রচ্ছদকারী জুলিয়ান।

লেখিকা সম্পর্কে
লেখিকা শান্তা নাজনীন বর্তমান সময়ের একজন জনপ্রিয় লেখিকা। যার ফলাফল হিসেবে পাঠকসমাজে তার এই বইটির জনপ্রিয়তা প্রতিনিধিত্ব করছে প্রথমদিক থেকেই। লেখালেখি তার কাছে নেশার মতোই বলা চলে। আর সে নেশাকে হয়তো পরিপূর্ণ একটি রূপ দিতে নহলী শান্তা নাজনীনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা লেখক সত্ত্বাকে বের করে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এই পাঠকসমাজের কাছে। এছাড়াও এই বইটিতে লেখিকার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারের দক্ষতা দেখে তার প্রশংসা না করে সত্যিই থাকা যায় না!

নেশা লাগিল রে
গল্পটি একটি রোমান্টিক গল্প। যেখানে বাউল দলের গায়িকা মোহিনী ও চেয়ারম্যানের ছেলে সৌরভের ভালবাসার গল্প ফুটে উঠেছে। গল্পে মোহিনী বিপদে পড়ে সৌরভের সাহায্য চাইতে গেলে গ্রামের লোকজন তাদের একসাথে দেখে ভুল বুঝে এবং সালিশ ডাকে। এই পরিস্থিতে সৌরভের বাবা অর্থাৎ গ্রামের চেয়ারম্যানের জাত যায় যায় অবস্থা। ঠিক তখনই চেয়ারম্যান সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং গল্পে নতুন মোড় নেয়।এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে গল্প।

আঁধারের ইতিকথা
এই গল্পটি মূলত পরিবারহীন এক ২৭-২৮ বছর বয়সী ছেলে সাইম এবং এলাকার এক বড় ভাই আশরাফকে ঘিরে। যে গল্পের মাঝে হারিয়ে ফেলেও পরে সাইম হঠাৎ তার পুরনো ভালবাসাকে ফিরে পায়। গল্পে আশরাফ ভাইয়ের সাইমের প্রতি ভালবাসা এবং অবদানও আপন বড় ভাইয়ের থেকে কম কীসে! রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও কিছু মানুষ আপন হয় তারই প্রতিফলন দেখা যায় এ গল্পটিতে।

গানের ওপারে
গানের ওপারে গল্পটি খুবই দারুণ লেগেছে। আমার কাছে। যে গল্পে শিক্ষা, বন্ধুত্ব, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যকার আত্মার সম্পর্ক,স্নেহের মায়া, আত্নসম্মানবোধ এবং জীবনবোধ এসব বিষয়গুলোকে একত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখিকা। যার প্রশংসা না করলেই নয়! এ গল্পের প্রতিটি চরিত্রই কোন না কোনভাবেই যেন হার না মানা এক সাহসী নারীর প্রচিচ্ছবি হিসেবে ফুটে উঠেছে।

যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম
প্রথমদিকে গল্পটিকে অতি সাধারণ মানের মনে হলেও শেষ দিকে গল্পের মজা পাওয়া গেছে। গল্পটিতে বিলেতবাসী হবার স্বপ্নে বিভোর এক ব্যাক্তির বিলেতি কোনো মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছা থাকলেও হঠাৎ সে পথে দেখা হওয়া এক যুবতীর প্রেমে পড়ে যায়। এমন গল্পকে অতি সাধারণই বলা চলে তবে শেষদিকে দেখা যায়, এই প্রেমে পড়া বা ভালবাসার এক মিষ্টি পরীক্ষা। যার ফলে অতি সাধারণ গল্পকেও লেখিকা ভিন্নভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করি।

বুকের বা’পাশে
গল্পটি মূলত একজন কিশোরের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার গল্প। একজন কিশোর নিজের অজান্তেই কিভাবে সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে? তাকে জড়িয়ে বেঁচে থাকা তারপাশের মানুষগুলোর যে করুণ অবস্থা হয়ে থাকে সকলকিছু খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে এ গল্পে।

বিজয়ের গান
গল্পটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প। আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প তা কি সেরা না হয়ে পারে! এ গল্পটিও তার ব্যতিক্রম নয়। গল্পে একজন মেডিকেল ছাত্রীর ডায়েরির পাতা থেকে তার স্মৃতিগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এ রোজনামচা থেকে পাঠক পরিচিত হবে নিরবে, নিভৃতে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা এক প্রেমিক কবি মুক্তিযোদ্ধার।

নির্ভরতার হাত
শান্তা নাজনীন এ গল্পে আমাদের ব্যাতিক্রম একজন সৎ মায়ের সাথে পরিচিত করেছেন। যা সচারাচর আমাদের সমাজে অকল্পনীয় ই বলা চলে। অর্থাৎ, সৎ মা আপন হয়ে তার সন্তানদের ভালবাসলেও বিনিময়ে কেবল ফিরে পেয়েছেন ঘৃণা আর অপবাদ। শেষদিকে এ গল্পে স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসায় সন্ধান মেলে একজোড়া নির্ভরতার হাতের।

সম্পত্তি
একটি পরিবারকে ঘিরে আবর্তিত হয় ‘সম্পত্তি’ গল্পটি। যে গল্পে ‘যেমন কর্ম, তেমন ফল’ বাক্যটিকেই ইঙ্গিত করে। গল্পটির গভীরতা বুঝতে গল্পটির একটি লাইন ই যথেষ্ট মনে করি। লাইনটি হলো-
বিধাতা হয়তো কাউকে কাউকে তার পাপের শাস্তি ইহজীবনেই দিয়ে দেন।

ফাগুনের দিন
এই গল্পটি আমাদের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময়কার গল্প। তবে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনার পাশাপাশি এখানে এক যুগলের মধুর ভালবাসার দারুণ পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে।

জেকের সাহেব ও তার সঙ্গী
এ গল্পটি খুবই মজার। এ গল্পের মোজাম্মেল সাহেবের মাঝে পাঠকেরা হুমায়ূন আহমেদ স্যার এর সৃষ্ট মিসির আলী’র প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাবে। এছাড়াও গল্পটিতে হেল্যুসিনেশন এবং ভৌতিক বিশ্বাসের সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে সমাধান দেয়া হয়েছে।

বাবা
বাবা-মেয়ের মধুর ভালবাসা ও বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে খুব দারুণভাবে সাজানো হয়েছে গল্পটিকে। বাবা হতে হলে মানুষের ঠিক কতটা গুণসম্পন্ন হতে হয় তারই ধারণা পাওয়া যায় গল্পটিতে।

সেরা গল্প
আমার কাছে “বিজয়ের গান” শিরোনামের গল্পটিকে এই বইটির সবচেয়ে সেরা গল্প মনে হয়েছে। এছাড়াও “জেকের সাহেব ও তার সঙ্গী” এবং “বাবা” গল্পটিও দারুণ প্রশংসনীয় লেখনী হিসেবেই মনে হয়েছে।

প্রিয় লাইন

শুধুমাত্র ‘বাবা একদিন ফিরবেন’ এই আশাটুকু নিয়ে আজও বেঁচে আছে। (গল্প- আঁধারের ইতিকথা)

একহাতে কড়া লিকারের চায়ের কাপ,আরেক হাতে নিকোটিন, সাতাশ-আঠাশ বছর বয়সী ছেলেপুলের কাছে এরচেয়ে অমৃত আর কী হতে পারে ? (গল্প- আঁধারের ইতিকথা)

ম্যাম তখন আমায় বুকের ভেতর জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বুঝিয়েছেন, “শানিন…বাবু শোন,বেঁচে থাকার জন্যই কেবল লড়াই করতে হয়, মরে যাওয়ার জন্য নয়।” (গল্প- গানের ওপারে)

কিন্তু, সত্যি এটাই যে, কাপুরুষের দল সবসময় পেছন থেকে হামলা করে। (গল্প- বিজয়ের গান)

এমন দিনও গেছে যেদিন নরপশুর দলের হাতে ধর্ষণ হওয়ার পরেও রোকেয়া আপা চিৎকার দিয়ে হেসে উঠতেন, থুথু ফেলে বলতেন, “আমি আমার আত্মসম্মান আর সতীত্ব যোনীতে নিয়ে ঘুরি না। ধর্ষিত তোরা, যারা আমাকে ধর্ষণ করেছিস!” (গল্প- বিজয়ের গান)

পুনশ্চ: যদি দূর আকাশের বুক থেকে তোমার অনুমতি ছাড়াই তোমাকে ‘সকাল’ বলে ডাকি, তুমি কি ভীষণ রাগ করবে ? (গল্প- বিজয়ের গান)

“জানো তো, আমি আজীবন একটা নির্ভরতার হাতের ভীষণ অভাববোধ করেছি।” (গল্প- নির্ভরতার হাত)

মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, পড়ে রয় সম্পত্তি। আসে নতুন কোনো ভাগীদার, জন্ম নেয় সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার নতুন লড়াই! (গল্প- সম্পত্তি)

বিধাতা হয়তো কাউকে কাউকে তার পাপের শাস্তি ইহজীবনেই দিয়ে দেন। (গল্প- সম্পত্তি)

ভক্তের তো আর জানা নেই, প্রতিবার অটোগ্রাফ লেখার নামে লেখক তার নক্ষত্র হয়ে যাওয়া বাবাকে উদ্দেশ্য করে এক একটা চিঠি লেখেন! (গল্প- বাবা)

পাঠ প্রতিক্রিয়া
গল্প সংকলন হিসেবে বইটি পড়ে খুবই দারুণ লেগেছে। পড়ার সময় একটুও হতাশা বা আশাহত হতে হয়নি। লেখিকার গল্প বলার ধরণের প্রশংসা করতেই হয়। একটা গল্প শেষে আরেকটা গল্প শুরুর জন্য যতই সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছি মনে হয়েছে গল্পগুলো আরো বেশী গভীর হতে শুরু করেছে, আরো বেশী সুন্দর ভাব ও বার্তা বহন করছে। যে ধরণের অনুভূতি পাঠককে ধরে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও গল্পগুলোর শিরোনামগুলো গল্পের সাথে খুবই মানানসই এবং গল্পের যথাযথ বার্তা বহন করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। একজন নতুনের কাছে এতটা মুগ্ধ করার মত লেখনী খুব কমই আশা করা যায়।

এ বইয়ের সবচেয়ে দারুণ ব্যাপারটি হচ্ছে লেখিকার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার এবং তার গল্প বলার ধরণ। এ দু’টি ব্যাপার আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছে। তবে নেশা লাগিল রে, সম্পত্তি, নির্ভরতার হাত গল্প তিনটি পাঠক হিসেবে আমার কাছে মোটেই ভাল লাগে নি। মনে হয়েছে সচারাচর সাধারণ কোনো নাটকের গল্প।

লেখিকা তার বইটিতে এগারোটি গল্পের মধ্যে প্রথম তিনটি গল্পই লিখেছেন পাবনা অঞ্চলের নাম ব্যবহার করে। জেকের সাহেব ও তার সঙ্গী গল্পটিতেও ঘুরেফিরে সেই পাবনা অঞ্চলেই লেখিকা তার পাঠকদের নিয়ে গেলেন। যা পাঠকের কাছে একঘেয়েমি লাগতে পারে। এই জায়গায় লেখিকার একটু ভাবা উচিত বা উন্নতির প্রয়োজন । এখানে ভিন্ন কোনো অঞ্চলের নাম অথবা কাল্পনিক কোনো নাম ব্যাবহার করা যেতো। ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহারে খুব সুন্দর ভিন্নতা আসতো বলে আমি মনে করি।

উপসংহারঃ
ছোট্ট একটু ঘাটতি ছাড়া বইটি গল্প সংকলন হিসেবে অনন্য বলা চলে৷ একটি গল্প সংকলনের বই হিসেবে ঠিক যেমন হওয়া উচিত, লেখিকা ঠিক সেরকম কিছু গল্প দিয়েই বইটিকে সাজিয়েছেন। যা পাঠকের মন জয় করবে বলে মনে করি। অবশেষে, বই এবং লেখিকা উভয়ের জন্যই রইলো শুভকামনা। সামনে লেখিকার কাছ থেকে আরো ভাল কিছুর আশাতে অপেক্ষায় রইলাম।

এক নজরে বই;

বই: নেশা লাগিল রে।
ধরণ: গল্প সংকলন
লেখিকা: শান্তা নাজনীন
প্রচ্ছদ: জুলিয়ান
প্রকাশনী: নহলী