মুফতি সফিউল্লাহ
দীনি শিক্ষাই আলো। সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। সুশিক্ষিত জাতি আগামীর ভবিষ্যৎ। মানব জীবনের জন্য শিক্ষা অত্যান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। এই শিক্ষা যদি হয় কোন মাদ্রাসা শিক্ষা তাহেলে তো আর কোন কথাই নেই। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সঃ বলেছেন:
প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক। ছাত্র -ছাত্রীর উত্তম চরিত্র গঠনের জন্য মাদ্রাসা গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বস্তুত আমাদের কওমি মাদরাসাসমূহে কেবলমাত্র কুরআন-হাদীসের জ্ঞানই শিক্ষা দেওয়া হয় না, বরং শিক্ষার্থীদেরকে সত্যিকারের মানুষ বানিয়ে দেওয়া হয়। আল-হামদু লিল্লাহ, আমাদের প্রতিষ্ঠানসমূহে ইলম শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি ছাত্রদের আমল-আখলাক ও তারবিয়তের দিকেও খেয়াল রাখা হয়।
আদর্শ ছাত্রের কিছু কর্তব্য আছে, বিশেষ একটি কর্তব্য হচ্ছে, একজন তা’লীমী মুরব্বী নির্ধারণ করে তার পরামর্শ ও নেগরানিতে চলা । এতে স্বাধীনতা নষ্ট হবে ভেবে নিজের খেয়াল-খুশিতে যখন তখন প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করে, মাঝে মাঝে শ্রেণি বাদ দিয়ে, অথবা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়ে, কিংবা নানা সমিতি ও সংঘের সাথে জড়িয়ে, এমন নাযুক সময়ে এ বিষয়টিকে খুবই গুরূত্ব দেওয়া উচিত।
একজন ছাত্র কিভাবে শিক্ষাজীবনে সফল হতে পারে এ ব্যাপারে উস্তাদরা অভিজ্ঞ। তাই সফল জীবন গড়তে চাইলে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করতে হবে। অনেক ছাত্র আছে নিজেই নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়। কখনো তারা কোন কোন ব্যক্তির কিতাব পড়ে উস্তাদের পরামর্শ না নিয়ে নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করে থাকে। ফলে তারা ব্যর্থ হয়।
শিক্ষকমণ্ডলীর সঙ্গে স্থায়ী ও দৃঢ় সম্পর্ক রাখা এবং তাঁদের দীর্ঘ ও বিশেষ সোহবত গ্রহণ করা ইলমের গুরুত্বপূর্ণ আদব। উস্তাযের সঙ্গে কেবল দরসের সম্পর্ক যথেষ্ট নয়। বর্তমানে উস্তাদ ও ছাত্রের সম্পর্ক নিভু নিভু প্রদীপের মত। অনেক ছাত্র পড়া শেষ করার পরে জীবনেও উস্তাদের সাক্ষাতে আসে না। কোন খোঁজ খবর রাখে না।
এলেমের জন্য হানা ফিল উস্তাদ হতে হবে নিজেকে এলেমের জন্য বিলীন করে দিতে হবে এ উক্তিটি প্রসিদ্ধ আছে –
العلم شيء لا يعطيك بعضه حتى تعطيه كلك ইলম এমন তুমি তোমার সবটুক ইলমের জন্য বিলিয়ে দিলে এলেম তোমাকে কিছু অংশ দান করবে। তারিখে বাগদাদ৬/৬২৩
এর দ্বারা স্পষ্ট বুঝা গেলো যে, অমনোযোগী ছাত্র ইলমের কিছুই পাবে না। কিছু মা‘লুমাত পেতে পারে. যা কোন উদ্দেশ্য নয়। ইলম ও মা‘লুমাতের মধ্যে আসমান যমীনের পার্থক্য। মা‘লুমাতকে ইলম করতে হলে মনোযোগ ও আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবত জরুরি ।ছাত্র জীবনে তালিমী মুরব্বির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সকলের নিকট সমাদৃত। সবাই এ কথাটি ভালোভাবে জানেন যে অভিভাবক ছাড়া কোন কাজে পূর্ণ সফলতা আশা করা যায় না। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে শুধুমাত্র কিতাব পাঠাননি বরং কিতাবের সাথে সাথে একজন শিক্ষককে পাঠিয়েছেন। তিনি আমাদের প্রিয় রাসূল হযরত মোহাম্মদ (সা.)।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন إن الله لم يبعثني معنتاً ولا متعنتاً ولكن بعثني معلماً وميسراً নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে কঠোরতা অবলম্বনকারী ও কষ্টদাতা হিসেবে প্রেরণ করেননি বরং আমাকে শিক্ষক ও সহজকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। (সহীহ মুসলিম ১৪৭৮)
সুতরাং আমাদের সকলকে অভিভাবক মেনে চলতে হবে, এটা আল্লাহ তাআলার নীতি ও পদ্ধতি। উস্তাযকে মুশীরে হায়াত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে না করে নিজেকে উস্তাযের হাতে সোপর্দ করতে হবে।
একজন ছাত্র তার প্রাথমিক জীবনে তালিমী মুরব্বি ব্যতীত সঠিক পথ নির্ণয় করতে পারে না। নিজের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ভুল পথে জীবন পরিচালিত করে।
তালিম মুরুব্বির পরামর্শ জীবনে কতটুকু কার্যকরী ও উপকারী তা ইমাম শাফি রাহিমাহুল্লাহ দুটি শের থেকে স্পষ্টভাবে বুঝে আসে ।
شكوت إلي وكيع سوء حفظي *فاوصاني إلي ترك المعاصي
فان العلم نورمن الهي* ونور الله لا يعطي لعاصى
الجواهر المضية في طبقات الحنفية 1/487)
(অর্থ:) আমি (আমার উস্তাদ) ওয়াকীর নিকট আমার স্মরণশক্তির দুর্বলতার কথা তুলে ধরলে তিনি আমাকে গুনাহ পরিত্যাগ করার অসীয়ত করলেন। কেননা, ইলম হল আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর। আর আল্লাহর নূর কোন পাপী ব্যক্তির ভাগ্যে জুটে না। ফারাগাতের পর নবীন আলেমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে।
আদব পড়বে নাকি হাদীস পড়বে নাকি ইফতার আলীমি মুরুব্বী না থাকার কারণে যার জন্য আদব পড়া জরুরী সে আদব না পড়ে ইফতায় ভর্তি হয়। এমনিভাবে খেদমত হওয়ার পরেও কিভাবে কি করতে হবে মুরুব্বী না থাকার কারণে পেরেশান থাকে। আমাদের আকাবিরগণ উস্তাদের সাথে সম্পর্ক শুধু দরছের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, কর্মজীবনেও তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, নির্দেশনা গ্রহণ করা, ইলমী সমস্যাবলির সমাধানের জন্য তাঁর শরণাপন্ন হওয়া এবং দুআ লাভ করা ইত্যাদি বিষয় জরুরী মনে করেছেন ।
হযরত থানভী রাহ.-এর একথা সবসময় মাথায় রাখা উচিত। তিনি বলেছেন:
جس کے سر پر کوئی بڑا ہو اس سے پوچھ کر سب باتیں کرنی چاہئیں، یہ تاکید لڑکوں کو رکھنی چاہئے۔ کمالات اشرفیہ ص : ২২৩
তালীমী মুরুব্বীর জন্য আমানতদার, দায়িত্বশীল, হিতাকাঙ্ক্ষী এবং সমঝদার ও অভিজ্ঞ হওয়া জরুরি। তালিমী মুরুব্বী তো কোনো একজন মানুষই হবেন,ফেরেশতা হবেন না। সুতরাং সামগ্রিক বিচারে শরীয়তের পাবন্দ ও আমানতদার হওয়াই যথেষ্ট।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে উস্তাদদের পরামর্শ অনুযায়ী চলার তাওফিক দান করুন! আমীন!
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া মিফতাহুল উলূম নেত্রকোনা
