জ্ঞানপিপাসু সম্রাট খলিফা আল মামুন

তানভীর স্বাধীন।।

খলিফা আল-মামুন। আব্বাসীয় খিলাফতে যে ক’জন শাসকের নাম চিরস্মরণীয় তাদের অন্যতম তিনি। দারুন বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষনতায় খিলাফতের ক্লান্তিকালে ত্রাণকর্তা হিসেবে সামনে অবস্থান করা মানুষ তিনি। তিনিই ছিলেন খলিফা হারুন-অর-রশীদের যোগ্য উত্তরসূরি এবং আব্বাসীয় খিলাফতের ৭ম খলিফা ।

খলিফা আল-মামুন ৭৮৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহন করেন। জন্মের মাত্র ৪০ দিন পরেই তিনি মাকে হারান। তার প্রকৃত নাম আবদুল্লাহ কিনওয়াত আবু জাফর। খলিফা মামুন ছিলেন অনেক গুণের অধিকারী— তিনি ছিলেন কুরআনের হাফেজ। তার সময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন সাহিত্যিক তিনি। আরবির ভাষা পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ভাষাতেও ছিলেন বেশ পারদর্শী। ছিলো হাদিসের উপর তার নিবিড় চর্চা। হাদিস লিপিবদ্ধকারী হিসেবেও তিনি সমাদৃত।

খলিফা আল-মামুন খিলাফতে বসার পূর্বে গৃহযুদ্ধে তার ভাই আল-আমিনকে পরাজিত করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও শান্ত স্বভাবের মানুষ। তিনি ৮১৩ সালে খিলাফতে বসে প্রায় ২০ বছর খিলাফতে অধিষ্ঠ ছিলেন। তার শাসনকালে প্রথম ৬ বছর মার্ভ (বর্তমান তুর্কমেনিস্তানের মেরির কাছে ঐতিহাসিক সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত) এবং পরবর্তী ১৪ বছর বাগদাদ শাসন করেন।

মুসলিম শাসকদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু। ঐতিহাসিকগন বলেন, তিনি প্রতিবছর পবিত্র রমজানের প্রায় ৩৩ বার কুরআন খতম দিতেন।

আব্বাসীয় যুগ ছিলো পৃথিবীতে ইসলামকে সম্প্রসারিত করার যুগ। এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে অবদান ছিলো খলিফা আল-মামুনের। শাসনকার্যের পাশাপাশি মুসলিম সভ্যতার বিকাশে তিনি অসমান্য অবদান রাখেন। কোনোভাবে সংকোচহীন না হয়ে ইসলামের প্রসার করেন। আব্বাসীয় খিলাফতকে ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয়।

মুসলিম যুগের শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন খলিফা মামুন। তিনি নিয়মিত বিভিন্ন শাস্ত্র গবেষনা ও চর্চা করতেন। আল মামুনের শাসন আমলের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ ছিল ‘বাইতুল হিকমা’ প্রতিষ্ঠা করা। এখানে গ্রিক, পারসিক ও সিরীয় ভাষায় রচিত অসংখ্য গ্রন্থ অনুবাদ এবং পরবর্তী গবেষণার জন্য সংরক্ষণ করা হতো। প্রচলিত আছে, যদি কোনো অনুবাদক অন্য ভাষা হতে কোনো গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করতেন, তবে তাকে উক্ত গ্রন্থের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণ দেওয়া হতো।

এই প্রতিষ্ঠানে তখন তিনটি বিভাগ ছিলো— গ্রন্থাগার, শিক্ষায়তন এবং অনুবাদ ব্যুরো। জ্ঞান ও বিজ্ঞানের প্রসার করার জন্য এই যুগকে অগাস্টান যুগের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে।

তেমনিভাবে ধর্ম, জাত নির্বিশেষে সবার নিজস্ব গ্রন্থ চর্চার স্বাধীনতা ছিলো। তার উধার পৃষ্ঠপোষকতায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বহু দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, আইনবিদ, হাদীস সংগ্রহ অনুভূতি মনীষিকগণ আতিথ্যগ্রহণ করতেন।

খলিফা মামুন একজন প্রখ্যাত কবি ও উচ্চ শিক্ষিত লোক ছিলেন। শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ ছিল প্রবল। শিক্ষার পরিধি বৃদ্ধি করার জন্য সম্রাজ্যে সর্বত্রে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি কৃষি ও শিল্পেরও ব্যপক উন্নতি সাধিত হয়। কৃষি কাজের জন্য জমি জরিপ, খাল খনন ও পানি নিষ্কাশনের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

তিনি শুধু শিক্ষা, জ্ঞান বিজ্ঞান, কৃষি নিয়ে কাজ করেছেন এমনটি বললে ভুল হবে, তিনি শত্রুর মোকাবেলা ও বিদ্রোহ দমনের প্রতিও গুরুত্ব দিয়েছেন। মেসোপটেমীয় অঞ্চলে বিদ্রোহ দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার দূরদর্শীতা ছিলো।

খলিফা আল-মামুনের সেনাবাহিনী ভূমধ্যসাগরীয় ক্রীট ও সিসিলি দখল করেছিলো। এ সময় পারস্যের মাজেন্দ্রান নামক স্থানে বাবেক নামক একজন দস্যু আগমন ঘটে। তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযান ব্যর্থ হলেও খলিফা স্বয়ং নিজে শূন্য পরিচালনা করে এই অভিযানে সফলতা অর্জন করেন। খলিফার সেনাবাহিনী কর্তৃক আফগান উপজাতিকে দমন করে তাদের অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়।

বাগদাদ শহরকে কেন্দ্র করে রোমানরা আক্রমন চালায়। এই আক্রমণ প্রতিহত করার পর খলিফা মামুন টুরসের ৭০ মাইল উত্তরে তারানা নামক স্থানে একটি সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণের নির্দেশ করেন।

এশিয়া মাইনরে অবস্থানরত সময় বাদানদুল দল নদীর তীরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৮৩৪ সালে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

খলিফা আল মামুন পৃথিবীতে যে কয়দিন বেঁচে ছিলেন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বদা চেষ্টা করে গেছেন এবং তিনি আব্বাসীয় খেলাফতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ খলিফা হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।