বাংলাদেশের দৃষ্টিনন্দন কয়েকটি মসজিদ

আব্দুল্লাহ আফফান।।

মসজিদ এক পবিত্র স্থান। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলামধর্মাবলম্বী। শুধু ইসলাম ধর্মের উপসনালয় হিসেবে নয়, কিছু মসজিদ তাঁর ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব দিয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে। দেশের বাইরে থেকেও পর্যটকরা আসেন মসজিদগুলোতে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে, একবার দেখার জন্য।

বায়তুল মোকাররম
বায়তুল মোকাররম, রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মসজিদটি ঐতিহ্যের প্রতীক। একসময় পারিবারিক উদ্যোগে এর নির্মাণ শুরু হলেও এটি বর্তমানে দেশের জাতীয় মসজিদ। এই মসজিদে হাজার হাজার মুসল্লিরা যান প্রাণের টানে। রাজধানী ঢাকার পল্টনে এই মসজিদের অবস্থান। ধারণক্ষমতার দিক দিয়ে বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম এই মসজিদটির রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।

শুধু ধর্মীয় দিক দিয়ে নয়, উন্নত স্থাপনার জন্যও এটি বিখ্যাত। ঢাকায় পুরাতন নিদর্শনের মধ্যেও এটি একটি। এছাড়া এর রয়েছে বিশ্বজুড়ে পর্যটক আকর্ষণ। প্রতি বছর শত শত বিদেশি পর্যটক, ফটোগ্রাফার, মিডিয়াকর্মী, ব্লগার এখানে আসেন। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা তো আসছেনই।

১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মুকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই সূত্রে পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে মসজিদটির জন্য প্রায় সাড়ে আট একর জায়গা নেওয়া হয়। স্থানটি নগরীর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র থেকেও ছিল নিকটবর্তী। সে সময় মসজিদের অবস্থানে একটি বড় পুকুর ছিল। যা “পল্টন পুকুর” নামে পরিচিত ছিল। পুকুরটি ভরাট করে ২৭ জানুয়ারি, ১৯৬০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান মসজিদটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।

এদিকে ঢাকা কোষ-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি লতিফ বাওয়ানি মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

এ মসজিদ কমপ্লেক্সের নকশার জন্য নিযুক্ত করা হয় সিন্ধুর বিশিষ্ট স্থপতি আব্দুল হুসেন থারিয়ানিকে। পুরো কমপ্লেক্স নকশার মধ্যে দোকান, অফিস, গ্রন্থাগার ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারি (শুক্রবার) প্রথমবারের মতো এখানে নামাজ পড়া হয়। ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। বর্তমানে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদটি আটতলা। নিচতলায় রয়েছে বিপণিবিতান ও একটি বৃহত্তর অত্যাধুনিক সুসজ্জিত মার্কেট কমপ্লেক্স।

২০০৮ সালে সৌদি সরকারের অর্থায়নে মসজিদটি সম্প্রসারিত করা হয়। পূর্বে ৩০হাজার মুসল্লি একত্রে নামায পড়লেও বর্তমানে এই মসজিদে একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এ মসজিদের শোভাবর্ধন এবং উন্নয়নের কাজ এখনও অব্যাহত রয়েছে। বায়তুল মোকাররম মসজিদটি ৮ তলা। নীচতলায় রয়েছে বিপণী বিতান ও বিশাল মার্কেট। দোতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত প্রতি তলায় নামাজ পড়া হয়। মসজিদের অভ্যন্তরে ওযুর ব্যবস্থাসহ নারীদের জন্য পৃথক নামাজের কক্ষ ও পাঠাগার রয়েছে।

মসজিদটির ১ম তলা ২৬ হাজার ৫১৭, দ্বিতীয় তলা ১০ হাজার ৬৬০, তৃতীয় তলা ১০ হাজার ৭২৩, চতুর্থ তলা ৭ হাজার ৩৭০, পঞ্চম তলা ৬ হাজার ৯২৫ এবং ষষ্ঠ তলার আয়তন ৭৪৩৮ বর্গফুট। জুম্মা ও ঈদের সময় বাড়তি ৩৯,৮৯৯ বর্গফুটে নামাজ আদায় করা হয়। এছাড়া, নারীদের জন্য রয়েছে ৬ হাজার ৩৮২ বর্গফুটের নামাজের জায়গা রয়েছে যা মসজিদের তিনতলার উত্তর পাশে অবস্থিত। পুরুষদের ওজুখানার জন্য ব্যবহৃত হয় ৬ হাজার ৪২৫ বর্গফুট। নারীদের ওজুখানার জন্য ব্যবহৃত হয় ৮৮০ বর্গফুট।

ষাটগম্বুজ মসজিদ
খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি না থাকায় এর নির্মাণকারী সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে এটি যে খান-ই-জাহান নির্মাণ করেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। ধারণা করা হয়, তিনি ১৫০০ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি বহু বছর ধরে বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে।

মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট, ভেতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট, ভেতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৮.৫ ফুট পুরু।

সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহর (১৪৩৫-৫৯) আমলে খান আল-আজম উলুগ খান-ই-জাহান সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তোলেন। খান-ই-জাহান বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল গড়ে তোলেন, যা পরে ষাটগম্বুজ মসজিদ হয়। তুঘলকি ও জৌনপুরি নির্মাণশৈলী এতে সুস্পষ্ট।

মসজিদটির পূর্ব দেয়ালে ১১টি বিশাল আকারের খিলানযুক্ত দরজা আছে। মাঝের দরজাটি অন্যগুলোর চেয়ে বড়। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে সাতটি করে দরজা। মসজিদের চার কোণে চারটি মিনার আছে। এগুলোর নকশা গোলাকার এবং ওপরের দিকে সরু হয়ে গেছে। এদের কার্নিসের কাছে বলয়াকার ব্যান্ড এবং চূড়ায় গোলাকার গম্বুজ আছে। মিনারগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিসের চেয়ে বেশি। সামনের দুটি মিনারে পেঁচানো সিঁড়ি আছে এবং এখান থেকে আজান দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এর একটির নাম রওশন কোঠা, অন্যটির নাম আন্ধার কোঠা।

মসজিদের ভেতরে ৬০টি স্তম্ভ বা পিলার আছে। এগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণে ছয় সারিতে অবস্থিত এবং প্রতি সারিতে ১০টি স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভই পাথর কেটে বানানো, শুধু পাঁচটি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এই ৬০টি স্তম্ভ এবং চারপাশের দেয়ালের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ। মসজিদটির নাম ষাটগম্বুজ মসজিদ হলেও এখানে গম্বুজ মোটেও ৬০টি নয়, গম্বুজ ১১টি সারিতে মোট ৭৭টি। পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজা ও পশ্চিম দেয়ালের মাঝের মেহরাবের মধ্যবর্তী সারিতে যে সাতটি গম্বুজ, সেগুলো দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের চৌচালা ঘরের চালের মতো। বাকি ৭০টি গম্বুজ অর্ধগোলাকার।

মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে ১০টি মেহরাব আছে। মাঝের মেহরাবটি আকারে বড় এবং কারুকার্যমণ্ডিত। এই মেহরাবের দক্ষিণে পাঁচটি এবং উত্তরে চারটি মেহরাব আছে। শুধু মাঝের মেহরাবের ঠিক পরের জায়গাটিতে উত্তর পাশে যেখানে একটি মেহরাব থাকার কথা, সেখানে আছে একটি ছোট দরজা।

২০১ গম্বুজ মসজিদ
টাঙ্গাইলের গোপালপুরে নির্মাণ করা হয়েছে ২০১ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। এ মসজিদের মিনারের উচ্চতা ৪৫১ ফুট (১৩৮ মিটার)। যা ৫৭ তলা ভবনের সমান। মসজিদে গম্বুজ আছে ২০১টি। মসজিদটির নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এটি হচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় উঁচু মিনারের মসজিদ।

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে ঝিনাই নদীর তীরে অবস্থিত ২০১ গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি। ২০১৮ সালের শেষ দিকে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। এখানে নির্মাণ করা হয়েছে দু’টি হেলিপ্যাড।

ডিজাইন ও কারুকার্যের দিক থেকে মসজিদটি একটি ভিন্ন সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে গড়ে উঠছে। মসজিদের টাইলসসহ ফিটিংসের যাবতীয় শোভাবর্ধনের শৌখিন কারুকার্যখচিত পাথরগুলো বিশ্বের কয়েকটি দেশ ঘুরে সংগ্রহ করা হয়েছে। এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটক ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আগমন ঘটে। বিশেষ করে জুমার নামাজে শরিক হতে বহু দূর থেকেও মানুষ আসেন।

বিশ্বের সর্বোচ্চ মিনারটি মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কায় দ্বিতীয় হাসান মসজিদে অবস্থিত। ওই মিনারের উচ্চতা ৬৮৯ ফুট (২১০ মিটার)। যা ৬০ তলা ভবনের সমান। তবে এটি ইটের তৈরি নয়। দিল্লির কুতুব মিনার বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ইটের তৈরি মিনার। এর উচ্চতা ৭৩ মিটার বা ২৪০ ফুট। মসজিদের ছাদের মাঝখানের গম্বুজটির উচ্চতা ৮১ ফুট, বাকি ২০০টি গম্বুজ ১৭ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। মূল মসজিদের চার কোণে রয়েছে ১০১ ফুট উচ্চতার চারটি মিনার। পাশাপাশি থাকবে ৮১ ফুট উচ্চতার আরও চারটি মিনার।

১৪৪ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪৪ ফুট প্রস্থের দ্বিতল মসজিদটিতে নামাজ আদায় করতে পারবেন একসঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার মুসল্লি। দেয়ালের টাইলসে অঙ্কিত থাকবে ৩০ পারা পবিত্র কোরআন শরিফ। যে কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে মসজিদের দেয়ালের কোরআন শরিফ পড়তে পারবেন। মসজিদের প্রধান দরজা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে ৫০ মণ পিতল।

বজরা শাহি মসজিদ
মোগল স্থাপত্যশৈলীর উজ্জ্বল নিদর্শন বজরা শাহি মসজিদ, যা নোয়াখালী জেলার প্রাণকেন্দ্র মাইজদী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা নামক স্থানে অবস্থিত। প্রায় তিন শ বছর আগে, ১৭৪১ সালে মোগল জমিদার আমান উল্লাহ খান দিল্লির বিখ্যাত জামে মসজিদের আদলে এই মসজিদ নির্মাণ করেন, যা আজও মোগল স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

জানা যায়, জমিদার আমান উল্লাহ তাঁর বাড়ির সামনে ৩০ একর জমির ওপর উঁচু পারযুক্ত একটি বিশাল দিঘি খনন করেছিলেন। সেই দিঘির পশ্চিম পারেই নির্মাণ করা হয়েছিল আকর্ষণীয় তোরণবিশিষ্ট ঐতিহাসিক এই মসজিদ। প্রায় ১১৬ ফুট দৈর্ঘ্য, ৭৪ ফুট প্রস্থ ও ২০ ফুট উচ্চতার তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ যে কাউকে মুগ্ধ করবে।

মসজিদকে মজবুত করার জন্য মাটির প্রায় ২০ ফুট নিচ থেকে ভিত তৈরি করা হয়েছিল। দৃষ্টিনন্দন মার্বেল পাথরে অলংকৃত করা হয়েছিল গম্বুজগুলো। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি ধনুকাকৃতি দরজা। প্রবেশপথের ওপরই রয়েছে কয়েকটি গম্বুজ। পশ্চিমের দেয়ালে আছে কারুকার্যখচিত তিনটি মেহরাব।

মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহর বিশেষ অনুরোধে মক্কা শরিফের বাসিন্দা, তৎকালীন অন্যতম বুজুর্গ আলেম হজরত মাওলানা শাহ আবু সিদ্দিকী ঐতিহাসিক এই মসজিদের প্রথম ইমাম হিসেবে নিয়োজিত হন। তার বংশধররা যোগ্যতা অনুসারে আজও এই মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

তারা মসজিদ
তারা মসজিদ পুরানো ঢাকার আরমানিটোলায় আবুল খয়রাত সড়কে অবস্থিত। সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত এ মসজিদ নির্মিত হয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। মসজিদের গায়ে এর নির্মাণ-তারিখ খোদাই করা ছিল না।

জানা যায়, আঠারো শতকে ঢাকার ‘মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদ’-এ (পরে যার নাম আরমানিটোলা হয়) আসেন জমিদার মির্জা গোলাম পীর (মির্জা আহমদ জান)। ঢাকার ধণাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি ছিলেন তিনি। মির্জা গোলাম পীর এ মসজিদ নির্মাণ করেন। ‌মির্জা সাহেবের মসজিদ হিসেবে এটি তখন বেশ পরিচিতি পায়। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর।

পরে, ১৯২৬ সালে, ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী, আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সে সময় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি পদার্থ ব্যবহৃত হয় মসজিদটির মোজাইক কারুকাজে। মোঘল স্থাপত্য শৈলীর প্রভাব রয়েছে এ মসজিদে। ঢাকার কসাইটুলীর মসজিদেও এ ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখ্য, দিল্লি, আগ্রা ও লাহোরের সতের শতকে নির্মিত স্থাপত্যকর্মের ছাপ পড়ে মোঘল স্থাপত্য শৈলীতে।

মির্জা গোলামের সময় মসজিদটি ছিল তিন গম্বুজঅলা, দৈর্ঘ্যে ৩৩ ফুট (১০.০৬ মিটার) আর প্রস্থে ১২ ফুট (৪.০৪ মিটার)। আলী জানের সংস্কারের সময়, ১৯২৬ সালে, মসজিদের পূর্ব দিকে একটি বারান্দা বাড়ানো হয়। ১৯৮৭ সালে তিন গম্বুজ থেকে পাঁচ গম্বুজ করা হয়। পুরনো একটি মেহরাব ভেঙে দুটো গম্বুজ আর তিনটি নতুন মেহরাব বানানো হয়। মসজিদের বতর্মান দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট (২১.৩৪ মিটার), প্রস্থ ২৬ ফুট (৭.৯৮ মিটার)।

আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ
চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ থেকে সোজা পশ্চিমে তিন কিলোমিটার গেলেই হালিশহরের বড়পোল এলাকা। সেখান থেকে আরো প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিম-উত্তরে এগুলেই হালিশহরের চৌধুরীপাড়া। ১৭৯৫ সালে এখানেই নির্মাণ করা হয় মোগল স্থাপত্য নকশায় চুন-সুরকির দৃষ্টিনন্দন আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ। মসজিদটি নির্মাণ করেন হালিশহরের সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারের প্রয়াত আজগর আলী চৌধুরী।

১০ শতক জায়গায় তৈরি মসজিদটির সামনে আছে বিশাল এক পুকুর, যা প্রায় ১০০ শতক জায়গাজুড়ে। মসজিদের দক্ষিণে ২০ শতক জায়গায় আছে কবরস্থান। উত্তরে ২৬ শতক জায়গার ওপর আছে চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠিত উত্তর হালিশহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

প্রায় আড়াই শ বছর আগে মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল তাজমহলের আদলে। মসজিদের ছাদে শোভা পেয়েছে বড় তিনটি গম্বুজ ও ২৪টি মিনার। পোড়ামাটির রঙের এই মসজিদের চারপাশ সাজানো হয়েছে নানা রকম নকশা দিয়ে। শুধু বাইরের দেয়ালই নয়, ভেতরের দেয়াল ও কাঠামোজুড়ে মোগল স্মৃতিচিহ্ন প্রদর্শন করে যাচ্ছে চোখ-ধাঁধানো নানা রকম নকশা। মজার ব্যাপার হলো, এই মসজিদে প্রচলিত কোনো জানালা নেই। মসজিদটি দেখতে দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক প্রতিদিন এখানে ভিড় জমায়।

তিন বছর আগে মোগল আমলে তৈরি মসজিদটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়লে ঐতিহ্যের দুর্লভ এই মসজিদ সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছনে নতুন একটি মসজিদ নির্মাণ করার কাজ শুরু হয়। মোগল স্মৃতিবিজড়িত এই মসজিদকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে খরচ করা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা।

এলাকাবাসীর আগ্রহে পুরাতাত্ত্বিক এই নির্দশন না ভেঙে পেছনে ৭০ শতক জায়গার ওপর সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন মসজিদটি নির্মাণ করছেন চৌধুরী পরিবারের ওয়ারিশরা। নতুন মসজিদের নকশাও নজর কাড়ছে দর্শনার্থীদের। নতুন মসজিদটি বানানো হয়েছে অনেকটা সংসদ ভবনের আদলে। মসজিদটির তিন পাশেই রাখা হয়েছে জলাধার। ওপর থেকে মনে হবে পানির ওপরই ভেসে আছে যেন আল্লাহর এই প্রিয় ঘর।

ধনবাড়ী শাহি মসজিদ
ইসলামী ঐতিহ্য ও কালের সাক্ষী হয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের ধারক ও বাহক টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী নওয়াব শাহি জামে মসজিদ। এটি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার প্রাণকেন্দ্র পৌরসভায় অবস্থিত।

মসজিদটির প্রথম খণ্ড নির্মাণ করেন তুর্কি বংশোদ্ভূত ইসপিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ নামের দুই সহোদর। পরবর্তী সময়ে মসজিদটির সম্প্রসারণকাজ করেন বাংলা ভাষার প্রথম প্রস্তাবক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, যুক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, ধনবাড়ীর বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। আজ থেকে ১১৫ বছর আগে মসজিদটির সম্প্রসারণের মাধ্যমে আধুনিক রূপ দেন তিনি।

প্রায় ১০ কাঠা জমির ওপর বানানো এই মসজিদ সংস্কারের আগে ছিল আয়তাকার। তখন এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৩.৭২ মিটার (৪৫ ফুট) এবং প্রস্থ ছিল ৪.৫৭ মিটার (১৫ ফুট)। বর্তমানে এটি একটি বর্গাকৃতির মসজিদ এবং সাধারণ তিন গম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকার মোগল মসজিদের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। সংস্কারের পর মসজিদের প্রাচীনত্ব কিছুটা লোপ পেলেও এর চাকচিক্য ও সৌন্দর্য অনেক বেড়েছে।

দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের ভেতরের দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে কড়িপাথরের লতা-পাতা আঁকা অসংখ্য রঙিন নকশা ও কড়িপাথরের মোজাইক, যা প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করছে। বাইরের দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে সিমেন্ট আর কড়িপাথরের টেরাকোটা নকশা।

মসজিদে প্রবেশ করার জন্য বানানো হয়েছে পাঁচটি প্রবেশপথ। পূর্ব দিকে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত তিনটি আর উত্তর ও দক্ষিণে আরো একটি করে দুটি—সর্বমোট পাঁচটি।

৩৪টি ছোট ও বড় গম্বুজ মসজিদটিকে করেছে আরো নান্দনিক। আরো আছে ১০টি বড় মিনার। প্রতিটির উচ্চতা ছাদ থেকে প্রায় ৩০ ফুট। মসজিদের দোতলার মিনারটির উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। মিনারের ওপর লাগানো তামার চাঁদগুলো মসজিদের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

মসজিদের ভেতরটা অলংকৃত করেছে মোগল আমলের তিনটি ঝাড়বাতি। শোভা পাচ্ছে সংরক্ষিত ১৮টি হাঁড়িবাতি, যা নারকেল ব্যবহার করে জ্বালানো হতো। সুপ্রাচীন মসজিদটিতে একসঙ্গে ২০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে।

মসজিদের পাশেই রয়েছে শান-বাঁধানো ঘাট ও কবরস্থান। এখানে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন নবাব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। মৃত্যুর দুই বছর আগে তিনি এই মসজিদে চালু করেন ২৪ ঘণ্টা কোরআন তিলাওয়াতের ব্যবস্থা (নামাজের সময় বাদে), যা গত প্রায় একশ’ বছরে এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। নিরবচ্ছিন্ন তিলাওয়াত সচল রাখতে নিয়োজিত আছেন পাঁচজন হাফেজ, যা প্রতিদিন মসজিদে আসা মুসল্লি ও দর্শনার্থীদের অভিভূত করে।

প্রাচীন আমলের মানুষের ইবাদত-বন্দেগি ও ইসলামী ঐতিহ্যের স্মৃতিচিহ্ন ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে ধনবাড়ী শাহি মসজিদ।